বিষ্ণুরাম সভয়ে বলল, “মোহনবাবু, এরা কি মরেটরে গেছে, নাকি!”
“না। দু নম্বর সুর শুনলে সবাই ঘুমিয়ে পড়ে।”
“তা হলে আমি ঘুমোচ্ছি না কেন?”
“তোর ওপর সুরটা ক্রিয়া করছে না, আমি সঙ্গে আছি বলে।”
“ঘুমোতে দিচ্ছেন নাই বা কেন?”
“তুই না এলাকার শান্তিরক্ষক?”
“আহা, শান্তিরক্ষকদের কি ঘুমোতে নেই?”
“সারাক্ষণ তুই তো ঘুমিয়েই থাকিস। তোর চোখ ঘুমোয়, মন ঘুমোয়, বিবেক ঘুমোয়, বুদ্ধি ঘুমোয়। আজ তোর জেগে ওঠার পালা।”
“আপনার কথা শুনে ভয়-ভয় করছে যে!”
“আজ ভয় পেলে চলবে না। আয়।”
হঠাৎ বাঁশির সুরটা পালটে একটা ভয়ংকর ভয়াল সুর বেজে উঠল। যেন পেতনির কান্না। হঠাৎ যেন হাহাকারে ভরে গেল চারদিক। হঠাৎ প্রলয়ের শব্দ তুলে হুহুঙ্কারে ছুটে আসছিল ঘূর্ণি ঝড়ের শব্দ। সেই সঙ্গে বিপুল জলের কলরোল।
বিষ্ণুরাম চেঁচাল, “কী হচ্ছে বলুন তো মোহনবাবু!”
“তিন নম্বর সুর।”
হঠাৎ পায়ের তলার মাটি দুলতে লাগল দোলনার মতো। মড়মড় শব্দ উঠল গাছের ডালপালায়, পাখিরা তারস্বরে চেঁচাতে লাগল, আকাশে ঝলকাতে লাগল বিদ্যুৎ।
তারপর আচমকাই সব শব্দ থেমে গেল। মাটির দোলন থেমে স্থির হল।
“তাড়াতাড়ি আয়। এবার বিপদ।”
“বিপদ! তা বিপদের মধ্যে আমাদের যাওয়া কি ভাল হচ্ছে?”
“পিস্তল বাগিয়ে আয়।”
লোকটা এত জোরে হাঁটছে যেন মনে হচ্ছে উড়ে উড়ে যাচ্ছে। বিষ্ণুরাম প্রাণপণে হেঁটেও তাল রাখতে পারছে না। থেমে যে উলটোদিকে পালাবে তারও উপায় নেই। একটা চুম্বকের মতো টান যেন তাকে টেনে হিঁচড়ে নিয়ে চলেছে।
সামনে থেকে মোহন রায় কেবল বলছে, “আয়, তাড়াতাড়ি আয়।”
***
বাঁশি থামতেই মহানন্দ শ্রীনিবাসের হাত থেকে বাঁশিটা কেড়ে নিয়ে হাসল। তারপর দুই কানের ভিতর থেকে দুটো তুলোর ঢিপলি বের করে ছুঁড়ে ফেলে দিয়ে বলল, “আজ চোখ আর কানের বিবাদভঞ্জন হল হে শ্রীনিবাস। তোমারও কাজ শেষ হয়ে গেল।”
শ্রীনিবাস জ্বলজ্বল করে চেয়ে ছিল মহানন্দের দিকে। বলল, “বিদ্যে তো পেয়ে গেলেন। কিন্তু মনে রাখবেন ওই বাঁশি এক মহৎ শিল্পের কাজ, এক দারুণ কারিগরের। পৃথিবীতে এমনটা আর হয়নি, হবেও না। ওটা দিয়ে মোটা দাগের কাজ করলে পস্তাতে হবে।”
মহানন্দ একটু হেসে পাঞ্জাবির ঝুল পকেট থেকে একটা পিস্তল বের করে শ্রীনিবাসের দিকে চেয়ে বলল, “এই বিদ্যের ভাগীদার থাকা কি ভাল শ্রীনিবাস?”
শ্রীনিবাস একটু হেসে বলল, “আমার কাজ ফুরিয়েছে মহানন্দবাবু। গুলিটা চালিয়ে দিন।”
রিভলভারের শব্দ হল।
কিন্তু শ্রীনিবাস অবাক হয়ে দেখল, সে নয়, তার বদলে মহানন্দই উপুড় হয়ে পড়ে আছে মেঝের ওপর। পিঠ থেকে রক্তের একটা ধারা নেমে আসছে মেঝেতে। আর দরজায় খোলা ধোঁয়ানো রিভলভার হাতে অবাক হয়ে দাঁড়িয়ে আছে বিষ্ণুরাম দারোগা। তার চোখে ভারী অবাক দৃষ্টি।
***
পরদিন সকালে নয়নতারা বলল, “দিন তো বাবা, ওই অলক্ষুণে বাঁশিটা উনুনে গুঁজে দিই।”
মৃদু আপত্তি করে পরাণ বলল, “আহা, কটা দিন থাক না হাতে। বেশি কিছু তো নয়, একখানা দোতলা বাড়ি, পনেরো বিশ বিঘে ধানী জমি, দুটো দুধেল গাই…”
শ্রীনিবাস বাঁশিটার গায়ে আদরে হাত বুলিয়ে বলল, “এমন শিল্পকর্ম কি নষ্ট করতে আছে রে! যেখানকার জিনিস সেখানেই ফিরিয়ে দিয়ে আসব।”
পরাণ বলল, “ছোটখাটো দু’একটা কাজ কারবার করে নিলে হয় বাবা?”
শ্রীনিবাস ঝোলা খুলে কয়েকটা মোহর, সোনার রেকাবি, রুপোর বাসন বের করে দিয়ে বলল, “এগুলো বেচে যা পাবি তাই দিয়ে একটা দোকান দে। চুরির ধাত তোর নয়, ও তোর হবে না।”
জিনিসগুলো দেখে পরাণ ভারী আহ্লাদিত হয়ে বলল, “এ থেকে আপনাকে কত ভাগ দিতে হবে বাবা?”
শ্রীনিবাস মৃদু হেসে বলে, “ভাগ দিবি? ভাগ করলে সব জিনিসই তো ছোট হয়ে যায় রে। আমার কি অল্পে হয়? অল্পে আমার মন ভরে বলে ভগবান যে আমাকে গোটা বিশ্ব সংসারটাই দিয়ে রেখেছেন। ভাগ নিয়ে তোরা থাক।”