হঠাৎ মুখটা উজ্জ্বল হল শ্রীনিবাসের। সে দুলে দুলে হেসে বলল, “খুব ঠিক। আমি ভাবছি, সরকার টাকাটা পাবে কোথায়। যতদূর শুনেছি, সরকারের টাকা আসলে দেশের মানুষেরই টাকা। তাই নাকি মহানন্দবাবু?”
মহানন্দ গম্ভীর হয়ে বলল, “সরকারের কত টাকা নয়ছয় হয় তুমি জানো? কত লোক সরকারি তহবিলের টাকা লুটমার করে নিচ্ছে! তা হলে আমাদের দোষ হবে কেন? সরকারি টাকা আসলে বেওয়ারিশ জিনিস। ও নিলে দোষ হয় না।”
“আমাকে সিকিভাগ দিতে চাও?”
“চাইলে আধাআধি বখরাও হতে পারে।”
ভ্রু কুঁচকে মহানন্দের দিকে চেয়ে শ্রীনিবাস ঠাণ্ডা গলাতেই বলল, “আমাকে একটা কথা বুঝিয়ে দেবে মহানন্দবাবু?”
“কী কথা?”
“আমাকে তুমি বখরাই বা দেবে কেন? ধরো বাঁশির বিদ্যে যদি আমি তোমাকে শিখিয়েই দিই তা হলে আমাকে বাঁচিয়েই বা রাখবে কেন তুমি? বুদ্ধিমান মানুষ কি তা করে?”
“তুমি ভাবছ বিদ্যেটা শিখে নিয়ে আমি তোমাকে মেরে ফেলব?”
“যুক্তি তো তাই বলে। শত্রুর কি শেষ রাখতে আছে?”
“আমি কথা দিলেও তুমি বিশ্বাস করবে না?”
“বিশ্বাস করার কারণ নেই যে।” মহানন্দ একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল, “তোমাকে ভাঙা যে সহজ হবে না তা আমি জানি তোমার মৃত্যুভয়ও নেই। তবে তোমার একটা দুর্বলতার খবর আমি রাখি শ্রীনিবাস।”
“তাই নাকি?”
“কেতুগড়ে তোমার পাশের বাড়িতে একটা ছোট পরিবার থাকে। নয়নচাঁদ আর তার বউ বিষাণী। তাদের একটা বছর পাঁচেকের ফুটফুটে ছেলে আছে, তার নাম গোপাল। তোমার এতদিন সংসারের কোনও মায়ার বন্ধন ছিল না। কিন্তু ওই গোপাল হওয়ার পর থেকে বিষাণী বাচ্চাটাকে তোমার কাছে রেখে ঘর-গেরস্থালির কাজ করত। আর তুমি গোপালকে কোলেপিঠে করে এত বড়টি করেছ। এখন সে তোমার নয়নের মণি, আর গোপালও দাদু ছাড়া কিছু বোঝে না। এখন ও তোমার হাতে খায়, তোমার কাছে ঘুমোয়।”
শ্রীনিবাসের মুখটা ধীরে-ধীরে শুকিয়ে যাচ্ছিল। সে একটু গলা খাঁকারি দিয়ে ধরা গলায় বলল, “কী বলতে চাও মহানন্দবাবু?”।
“গোপালের ভাল-মন্দের জন্যই বলছি, আমার প্রস্তাবে রাজি হয়ে যাওয়াই সকলের পক্ষে মঙ্গল। যদি তুমি আমাকে ফিরিয়ে দাও আমি তোমাকে মারব না শ্রীনিবাস, কিন্তু গোপালকে তুলে নেব। তারপর যে কদিন তুমি বাঁচবে দগ্ধে দগ্ধে মরবে। এখনও ভেবে দ্যাখো।”
শ্রীনিবাস কিছুক্ষণ গুম হয়ে বসে রইল। তারপর একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে ধরা গলায় বলল, “মহানন্দবাবু, আমি জানি বিদ্যেটা শেখার পর তুমি আমাকে মেরে ফেলবে। মরতে আমার ভয়ও নেই। শুধু বলি, শেষবারের মতো ভেবে দেখো, ওই সর্বনেশে বাঁশি কাজে লাগাবে কি না।”
“আমার ভাবা হয়ে গেছে শ্রীনিবাস। আমি তোমাদের মতো বোকা নই। সম্পদ কাজে না লাগানোও অন্যায়।”
শ্রীনিবাস হাত বাড়িয়ে বলল, “বাঁশিটা দাও। আর ঘর থেকে ওদের বেরিয়ে যেতে বলল।”
.
মাঝরাত্তিরে হঠাৎ কাতুকুতু খেয়ে গাঢ় ঘুম থেকে জেগে উঠল বিষ্ণুরাম, ভারী অবাক হয়ে বলল, “এ কী রে! কাতুকুতু দেয় কে? অ্যাঁ! আরে, আমার কাতুকুতু লাগছে কেন? কী মুশকিল!”
কে একটা চাপা গলায় ধমক দিল, “চোপ! উঠে পড়, সময় নেই।”
বিষ্ণুরাম ভয় খেয়ে ফ্যাঁসফ্যাঁসে গলায় বলল, “কে রে তুই? চোর নাকি রে? অ্যাঁ! চোর? ওরে বাপু, দারোগার বাড়িতে চুরি করতে ঢুকলে কী হয় জানিস? পেনাল কোডে লেখা আছে, দারোগার বাড়িতে চুরি করলে ফাঁসি হয়। বুঝলি!”
“বুঝেছি। কিন্তু আমার ফাঁসি হওয়ার উপায় নেই। উঠে পড়, নইলে আবার কাতুকুতু দেব।”
বিষ্ণুরাম ভয় পেয়ে উঠে পড়ল। অন্ধকারে খাটের পাশে একটা আবছা মতো মানুষকে দেখে সে কাঁদো কাঁদো হয়ে বলল, “ওরে, গাঁয়ে তো আরও বাড়ি আছে, সেখানে যা না। যা বাবা, যত পারিস চুরি কর গে, কিচ্ছু বলব না। ওরে, আমি কি কখনও তোদের কাজে বাগড়া দিয়েছি, বল।”
“জানি, তুই হলি ষাঁড়ের গোবর। পোশাক পরে পিস্তলটা হাতে নে।”
“আমাকে হুকুম করছিস! সাহস তো কম নয়! তুই কে রে?”
“আমি মোহন রায়।”
“সেটা আবার কে?”
“বেশি কথার সময় নেই। বাঁশি শুনতে পাচ্ছিস?”
“বাঁশি!” বলে একটু অবাক হয়ে বিষ্ণুরাম চুপ করল। বাস্তবিক একটা ভারী অদ্ভুত সুরেলা শব্দ যেন বাতাসে নেচে নেচে বেড়াচ্ছে।
শুনলে যেন রক্ত নেচে ওঠে।
বিষ্ণুরাম বলল, “বাঃ, বেশ বাজায় তো!”
“এটা এক নম্বর সুর।”
“তার মানে?”
“মানে বলার সময় নেই। দরজা খুলে বেরো, আমি পথ দেখিয়ে নিয়ে যাচ্ছি।”
“কিন্তু তোকে এত আবছা দেখছি কেন? স্বপ্ন নাকি?”
“না। স্বপ্ন নয়, আমাকে আবছাই দেখা যায়।”
“তা যেতে হবে কোথায়?”
“কাজ আছে। কথা না বলে বেরিয়ে পড়।”
বিষ্ণুরামের হঠাৎ মনে হল, এ লোকটা যে সে লোক নয়। ভারিক্কি গলা, বেশ দাপট আছে, কেউকেটা কেউ হবেও বা। সে একটু নরম হয়ে বলল, “তা না হয় যাচ্ছি, কিন্তু আপনার পরিচয়টা?”
“পরে হবে। ওই যে দু’নম্বর সুর বাজছে।”
বিষ্ণুরাম পথে বেরিয়ে সামনের আবছা লোকটার পিছু পিছু যেতে শুনতে পেল, বাঁশির সুরটা পালটে গেছে। ভারী নেশাড়ু একটা সুর চারদিকে যেন ঘুম-ঘুম ভাব ছড়িয়ে দিচ্ছে। বিষ্ণুরাম একটা হাই তুলতে গিয়ে দেখল, রাস্তায় ঘাটে, মাঠে, ময়দানে, এখানে সেখানে লোকজন শুয়ে ঘুমোচ্ছে। গরমে লোকে ঘরের বাইরে অনেকে ঘুমোয় বটে, কিন্তু পথেঘাটে এরকম পড়ে থাকে না তো!