এর মধ্যেই দুটো ছেলে দৌড়ে গিয়ে বিষ্ণুরামকে খবর দিল, “বড়বাবু, গাঁয়ে দশ বারোজন লোক ঢুকে পড়েছে।”
বিষ্ণুরাম রাতে বারোখানা পরোটা খায়, সঙ্গে মাংস, শেষপাতে ক্ষীর আর মর্তমান কলা। মাত্র পাঁচ নম্বর পোটাটি ছিঁড়ে মাংসের ঝোলে ডুবিয়েছে, এমন সময় উটকো ঝামেলা।
বিষ্ণুরাম উঠে জানালার পাল্লা সাবধানে ফাঁক করে বলল, “কী হয়েছে?”
ছেলেদুটো হাঁফাতে হাঁফাতে বলল, “ভীষণ বিপদ বড়বাবু, গাঁয়ে দশ বারোজন তোক ঢুকে পড়েছে যে!”
বিষ্ণুরাম বিজ্ঞের মতো হেসে বলল, “হ্যাঁ রে, পেনাল কোডে কোন ধারায় বলা আছে যে, গাঁয়ে তোক ঢোকা বারণ?”
“আজ্ঞে, তা তো জানি না।”
“ওইটেই তো তোদের মুশকিল। কিছু জানিস না, না জেনেই চেঁচামেচি করিস। ওরে বাপু, আমি হলুম আইনের রক্ষক। আইন ছাড়া আমি এক পাও চলতে পারি না। তোক যদি ঢুকে থাকে তো কী হয়েছে? ঢুকতে দে না। কত আর ঢুকবে?”
“কিন্তু বড়বাবু, তাদের হাতে বন্দুক আছে, তরোয়াল আর লাঠি আছে।”
ভ্রু কুঁচকে বিষ্ণুরাম বলল, “অস্ত্র থাকলেই তো হবে না। তাদের উদ্দেশ্য কী বুঝতে হবে। খুনজখম যদি নিতান্তই হয় তখন না হয় কাল সকালে দেখা যাবে। তোরা বরং পরিস্থিতির ওপর নজর রাখ। যা-ই ঘটুক, সাহসের সঙ্গে মোকাবিলা কর। আমি তো তোদের পিছনেই আছি।”
ছেলে দুটো বিমর্ষ মুখে ফিরে গেল।
বিষ্ণুরাম ধীরে সুস্থে মাংস পরোটা আর ক্ষীর খেয়ে বিছানায় গিয়ে শুয়ে পড়ল।
ওদিকে নরেন্দ্রনারায়ণ তার দলবল নিয়ে যখন পরাণ দাসের বাড়িতে হাজির হল তখন চারদিক সুনসান। বিভীষণের মতো চেহারার একটা লোকের এক ধাক্কাতেই দরজাটা মড়াত করে খুলে গেল। নরেন্দ্রনারায়ণ টর্চ ফেলে দেখল, মেঝেতে মাদুর পেতে অঘোরে ঘুমোচ্ছ শ্রীনিবাস।
গম্ভীর গলায় সে ডাকল, “শ্রীনিবাস!”
শ্রীনিবাস এক ডাকেই উঠে পড়ল। চোখ মিটমিট করে চেয়ে বলল, “মহানন্দবাবু যে! সঙ্গে এত লোকজন কেন বলুন তো! অস্ত্রশস্ত্রই বা কেন?”
“আমি তোমাকে ভয় দেখাতে আসিনি শ্রীনিবাস। বরং তোমার সঙ্গে একটা চুক্তি করতেই এসেছি।”
“কীসের চুক্তি?”
“আমার মনে আছে, অনেক দিন আগে আমি যখন ছোট ছিলুম তখন তুমি আমাকে আড়বাঁশি বাজাতে শিখিয়েছিলে। মনে পড়ে?”
“পড়ে।”
“আজ আবার তোমার কাছে বাঁশি শিখতে এসেছি। এই বাঁশিটা।” বলে নরেন্দ্রনারায়ণ ওরফে মহানন্দ মোহন রায়ের বাঁশিটা বের করে দেখাল।
শ্রীনিবাস নিরুত্তাপ চোখে বাঁশিটা দেখে চোখ ফিরিয়ে নিল। নরেন্দ্রনারায়ণ বলল, “বাঁশিটা চেনো?”
“চিনি মহানন্দবাবু।”
“চেনারই কথা। বাঁশিটা চুরি করে তুমি আমাকে অনেক দৌড়ঝাঁপ করিয়েছ।”
শ্রীনিবাস উদাস গলায় বলল, “ভালর জন্যই চুরি করেছিলাম।”
“কার ভালর জন্য শ্রীনিবাস? এ বাঁশির জোরে রাজা হওয়া যায়। কিন্তু তুমি তো তা হওনি৷ ফ্যা-ফ্যা করে ঘুরে বেড়াচ্ছ। কী ভালটা হল তোমার?”
তেমনি উদাস গলায় শ্রীনিবাস বলে, “সবার ভাল কি একরকম?”
“তোমার ভালটা কীরকম তা আমার খুব জানতে ইচ্ছে করে। একসময়ে তুমি নামকরা চোর ছিলে। শুনতে পাই, তুমি নাকি লাখো লাখো টাকা রোজগার করেছ। কিন্তু দান-খয়রাত করে সব উড়িয়ে দিয়ে সর্বস্বান্ত হয়ে একখানা কুঁড়ে ঘরে মাথা গুঁজে পড়ে থাকো। উলোঝুলো পোশাক পররা, ভালমন্দ খাবার জোটে না, লোকে ১০৪
খাতির করে না, সমাজে প্রতিষ্ঠা পাওনি, তা হলে ভালটা কী হয়েছে বলতে পারো? তুমি তো আর সাধু-সন্ন্যাসী নও।”
শ্রীনিবাস নিস্পৃহ গলায় বলল, “সাধু হওয়া কি সোজা?”
“শোনো শ্রীনিবাস, আমি জানি না তুমি পাগল,নাকি বোকা, নাকি বৈরাগী। তবে তুমি যে একটি অদ্ভুত লোক তাতে সন্দেহ নেই। এভাবে বেঁচে থাকতে কি তোমার ভাল লাগে? বুড়ো হয়েছে, এখন একটু ভোগসুখ করতে ইচ্ছে যায় না? ধরো যদি অসুখবিসুখ করে, বিছানায় পড়ে যাও তা হলেই বা কে তোমাকে দেখবে, ডাক্তার বদ্যিরই বা কী ব্যবস্থা হবে, এসব ভেবেছ? তোমার তো তিনকুলে কেউ নেই, একা মানুষ, হাতে টাকা পয়সা না থাকলে তোমার গতিটা কী হবে জানো?”
শ্রীনিবাস একটু হেসে বলল, “তা আর ভাবি না? খুব ভাবি। ভেবে ভয়ও হয় খুব। তুমিও যে আমার কথা এত ভাবো তা জেনে বড় ভাল লাগল।”
“ইয়ার্কি নয় শ্রীনিবাস, আমি ভাবের ঘোরে চলি না। আমি কাজের লোক। হাতে ক্ষমতা পেয়েও যদি কেউ সেই ক্ষমতা কাজে
লাগায় তা হলে সে আহাম্মক। এই যে অদ্ভুত বাঁশিটা দেড়শো বছর ধরে রাজবাড়িতে পড়ে আছে এটা কি ঠিক হচ্ছে? মোহন রায় অনেক মাথা খাঁটিয়ে, বিস্তর মেহনতে এটা তো ফেলে রাখার জন্য তৈরি করেননি! তাঁর অপোগণ্ড বংশধরেরাও বাঁশিটা কেউ কাজে লাগায়নি। এখন দুনিয়ার তুমিই একমাত্র লোক যে এই বাঁশির বিদ্যেটা জানো। তুমি মরে গেলে এই বাঁশি চিরকালের মতো বোবা হয়ে যাবে। এত বড় একটা সম্পদ নষ্ট হবে। ভেবে দ্যাখো শ্রীনিবাস। বিদ্যেটা দিয়ে যাও, বাঁশিটা সার্থক হোক।”
“বিদ্যেটা শিখে তুমি কী করবে মহানন্দবাবু?”
“তোমাকে মিথ্যে কথা বলব না। লোককে ঘুম পাড়িয়ে এলাকা লুট করার মতো ছোট নজর আমার নয়। কথা দিচ্ছি, সাধারণ মানুষের ধনসম্পত্তিতে আমি হাতও দেব না। আমি বন্দোবস্ত করব সরকার বাহাদুরের সঙ্গে।”
অবাক হয়ে শ্রীনিবাস বলল, “সেটা কী রকম?”
“আমি জানি, তিন নম্বর সুরে প্রলয় কাণ্ড হয়। ঘূর্ণিঝড় ওঠে, বান ডাকে, ভূমিকম্প হয়। ধরা যাক, আমি সরকার বাহাদুরকে খবর দিলাম, অমুক দিনের মধ্যে আমাকে একশো কোটি টাকা না দিলে অমুক দিন অতটার সময় অমুক জায়গায় প্রলয়ংকর কাণ্ড এবং ভূমিকম্প হবে। সরকার প্রথমে পাত্তা দেবে না। কিন্তু নির্দিষ্ট দিনে, ঠিক সময়ে সেই জায়গায় যদি তাই হয় তা হলে সরকার নড়েচড়ে বসবে। দু’বার বা তিনবার একই কাণ্ড ঘটলে তখন আর সরকার চুপ করে থাকতে পারবে না। ভয় পেয়ে আমার দাবি মিটিয়ে দেবে। তোমাকে কথা দিচ্ছি আমার রোজগারের চার আনা ভাগ তোমার। ভাল করে ভেবে দ্যাখো, এ কাজে খারাপ কিছু নেই। টাকাটা দেবে সরকার। আর সরকারের টাকার ওপর হক তো আমাদের আছেই। ঠিক কি না!”