“রাজি হলে বুঝি?”
“হলুম। প্রস্তাবটা তো খারাপ নয়।”
“ও, তা হলে তুমিই রাজবাড়ির চুরি-যাওয়া জিনিস ময়নাগড়ের বাড়ি বাড়ি ফিরি করে বিক্রি করেছ! বদরুদ্দিন বলছিল বটে, একজন বুড়ো ফিরিওলা ময়নাগড়ে কোন রাজবাড়ির জিনিস খুব শস্তায় বিক্রি করে গেছে।”
“শস্তায় না দিলে গাঁয়ের মানুষ কিনবে কেন বলো!”
“তা তো বুঝলুম, কিন্তু চালে কি একটু ভুল হল না?”
“চালে ভুল! তো বুড়ো হয়েছি, ভুলভাল হতেই পারে। কী ভুল হল বলল তো!”।
ইরফান দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল, “ভুল নয়? বাঁশিটা হাতছাড়া হল যে।”
শ্রীনিবাস চিন্তিত মুখে বলল, “হাতছাড়া কি সহজে হতে চাইছিল বাঁশিটা? বটেশ্বর সেটা এমন লুকিয়ে রেখেছিল যে, মহানন্দ সারা জীবনেও খুঁজে বের করতে পারত না। তারপর বাঁশি বাজাতে যেত আবার ভুতুড়ে দীঘির ধারে, যেখানে জনমনিষ্যি যায় না। তাই বাঁশিটা যে বটেশ্বরের কাছে আছে সে খবরটা আমিই মহানন্দকে দিয়েছিলুম।”
“তুমি!” বলে হাঁ হয়ে গেল ইরফান।
মৃদু হেসে শ্রীনিবাস বলে, “তা ছাড়া উপায় কী বলল। বেচারা বাঁশির হদিশ পেতে খুঁজে খুঁজে হয়রান হচ্ছিল যে। তাই একদিন হাটখোলার কাছে অন্ধকারে সাধু সেজে তার পথ আটকে বললুম, পাঁচটা টাকা দে। তা হলে যা খুঁজছিস তার হদিশ পেয়ে যাবি। একটু কিন্তু কিন্তু করছিল বটে, তবে দিয়েছিল। তখন বললুম সন্ধের পর ময়নাদিঘির ধারে যাস, পেয়ে যাবি।”
ইরফান গম্ভীর হয়ে বলল, “কাজটা ভাল করোনি শ্রীনিবাস। খবরটা দিয়েছিলে বলে যে বটেশ্বর মরতে বসেছিল! সময় মতো আমি গিয়ে পড়েছিলুম বলে রক্ষে। ঠ্যাঙার ঘা খেয়ে পালিয়েছিল, নইলে–”
শ্রীনিবাস দুলে দুলে একটু হেসে বলে, “বাপু, ঠ্যাঙার ঘা-টা তুমি জব্বর দিয়েছিলে বটে। নিজের চোখেই তো দেখলুম। তবে তোমার ঠ্যাঙার সঙ্গে আমার গুডুলও ছিল যে!”
“অ্যা। বলল কী!”
“বাবলা ঝোঁপের আড়াল থেকে এই এতবড় একখানা গুডুল গুলতিতে ভরে মারলুম যে! তোমার ঠ্যাঙার ঘাও পড়ল, আমার গুডুলও গিয়ে গুণ্ডাটার কপালে লাগল। তোমার ঠ্যাঙার জোর বেশি, না আমার গুড়ুলের জোর বেশি তা বলতে পারব না। তবে কাজ হয়েছিল।”
“বটে!”
.
বটতলার অন্ধকার রাস্তা দিয়ে জনাদশেক লোক ময়নাগড়ে ঢুকছিল। সকলের সামনে ধুতি-পাঞ্জাবি পরা নরেন্দ্রনারায়ণ। তার এক হাতে টর্চ, অন্য হাতে ধুতির কোঁচাখানা মুঠো করে ধরা। পিছনে দু’জনের হাতে বন্দুক, দু’জনের হাতে খোলা তলোয়ার, দু’জনের হাতে সড়কি আর বাকিদের হাতে লম্বা লম্বা লাঠি। প্রত্যেকেরই বিরাট বিরাট শরীর। তারা ভারী ভারী পায়ের শব্দ তুলে বুক ফুলিয়েই ঢুকছে।
বটতলা পেরোতেই টর্চের আলো এসে পড়ল তাদের ওপর। প্রভঞ্জন ডাক্তার হুঙ্কার দিয়ে উঠল, “কে রে? কারা তোরা?” বলে তেড়ে এসেই টর্চের আলোয় লোকগুলোর মূর্তি দেখে ভারী নরম হয়ে পড়ল প্রভঞ্জন। মোলায়েম গলায় বলল, “আসুন, আসুন। কাকে খুঁজছে বলুন তো! ও ব্রজ, দ্যাখো এঁরা কার বাড়ি যাবেন, বরং সঙ্গে নিয়ে গিয়ে পৌঁছে দিয়ে এসো।”
নরেন্দ্রনারায়ণ গম্ভীর গলায় বলল, “তার প্রয়োজন হবেনা। বাড়ি আমরা চিনি।”
নগেন পাল বিগলিত হয়ে বলল, “তা চিনবেন বইকী, এ তো আপনারও গ্রাম। তা হাওয়া খেতে বেরিয়েছেন বুঝি! খুব ভাল। যা গরমটা পড়েছে আজ!”
লোকগুলো প্রভঞ্জনের দলের দিকে ভ্রুক্ষেপ না করে সদর্পে এগিয়ে গেল।
হাটখোলার কাছে হ্যাজাক জ্বেলে কালীপদর দলবল ওত পেতে ছিল। উটকো লোকজন দেখে সবাই ‘রে রে’ করে উঠল। কিন্তু দলটা কাছে আসতেই তাদের মূর্তি দেখে কালীপদ তটস্থ হয়ে বলে, “নরেন্দ্রনারায়ণবাবু যে! তা শরীর গতিক ভাল তো! বাড়ির সবাই ভাল আছে? খোকাখুকিদের খবর সব ভাল? আর গিন্নিমা! হেঃ হেঃ, আজকাল তো আর দেখাই পাই না আপনার! মাঝে মাঝে চলে আসবেন এরকম হুটপাট করে। আমরা তো আর পর নই।”
নরেন্দ্রনারায়ণ তার দিকে একটা অগ্নিদৃষ্টি হেনে গটগট করে এগিয়ে যেতে লাগল, পিছনে তার বাহিনী।
কে একজন যেন জিজ্ঞেস করল, “কারা এরা কালীপদদা?”
“চিনলি না? বিরাট লোক! বিরাট লোক।”
আর কেউ কোনও উচ্চবাচ্য করল না।
তিন নম্বর দলটার সঙ্গে দেখা হল রথতলায়। নবু কালীবাড়ি থেকে বলির খাঁড়াটা ধার করে এনেছিল। সেটা বেজায় ভারী বলে খাঁড়াটা মাটিতে শুইয়ে তার ওপর বসে চারদিকে নজর রাখছিল। সামনে হঠাৎ লোকজন সাড়া পেয়ে খাঁড়া হাতে উঠে গর্জন করল, “খবর্দার! আর কাছে এলেই কিন্তু এসপার ওসপার হয়ে যাবে, এই বলে রাখলুম!”
কিন্তু দলটা কাছে আসতেই নবু খ্যাখ্যাল করে হেসে বলল, “আপনারা! তাই বলুন। আমি ভাবলাম কে না কে যেন! তা গোবিন্দপুরে কেনারাম বিষয়ীর মেয়ের বিয়েতে যাচ্ছেন তো! হ্যাঁ, এই রাস্তাই। সামনে এগোলে বাঁ হাতে রাস্তা পাবেন, মাইলটাক গেলেই গোবিন্দপুর। জব্বর খাইয়েছে মশাই, মাছের কালিয়াটা যা হয়েছে না…”
নরেন্দ্রনারায়ণ একটু কুটি করে তার দিকে চাইতেই নবু চুপসে গেল।
প্যাংলা ঠিকমতো ধার ঘেঁষে দাঁড়ায়নি। একটা ষণ্ডা তাকে কনুইয়ের একটা রাম-গুতোয় ছিটকে ফেলে দিল। যন্ত্রণায় কোঁক করে উঠল সে। পরমুহূর্তেই গা ঝাড়া দিয়ে উঠে উদ্বেগের সঙ্গে বলে উঠল, “আপনার ব্যথা লাগেনি তো ভাই? আহা, আমার বুকে গুঁতো খেয়ে কচি হাতটা বোধহয় জখম হল ছেলেটার!”