“তারপর?”
“সাতদিন বাদে বাঁশি বাজাতে শিখে গেলাম।”
“তা কী দেখলে, সত্যিই ওসব হয় নাকি?”
“হয়। নবীন রায় প্রতিদিন একটা করে জীবজন্তু নিয়ে গর্ভগৃহে আসতেন। কখনও কুকুর বা বেড়াল, কখনও ছাগলছানা বা বেজি, কখনও বানর বা পোষা পাখি। প্রথম সুরটা শুনলেই ওরা আনন্দে যেন মাতালের মতো হয়ে যেত। দ্বিতীয় সুরে নিঃসাড়ে ঘুমিয়ে পড়ত।”
“আর তৃতীয় সুরে?”
“সেটা বাজালেই ঘরটা যেন দুলে উঠত আর বাইরে থেকে একটা সোঁ সোঁ আওয়াজ আসত। তিন নম্বর সুরটা অবশ্য খুব অল্প একটু বাজিয়েই বন্ধ করে দিতেন নবীন রায়। লোকে তেমন টের পেত না।”
“তারপর কী হল?”
“বিদ্যেটা শিখিয়ে দিয়ে নবীন রায় ভারী নিশ্চিন্ত হলেন। বেশিদিন বাঁচেননি তারপর। কেতুগড়ের লোক জানল, বিদ্যেটা নবীন রায়ের সঙ্গেই শেষ হয়ে গেছে।”
“আহা, থামলে কেন? তারপর কী হল?”। “এই বলছি, একটা লাউপোস্তর ঢেকুর উঠল কিনা। ভাল কিছু খেলে তার ঢেকুরটাও বড় ভাল লাগে, এটা লক্ষ করেছ?”
একগাল হেসে ইরফান গাজি বলে, “তা আর করিনি! এই তো সেদিন ইলিশের মাথা দিয়ে কচুর শাক রান্না হয়েছিল, কী যে ভাল ভাল ঢেকুর উঠল ভাই, তা আর বলার নয়।”
পরাণ বিরক্ত হয়ে বলল, “একটা গুরুতর কথার মধ্যে কেন যে গুচ্ছের বাজে জিনিস ঢুকে পড়ছে কে জানে বাবা।”
শ্রীনিবাস মিটমিট করে তার দিকে চেয়ে বলল, “বুড়ো বয়সের ওটাও একটা দোষ, বুঝলি? এক কথায় আর এক কথা এসে পড়ে। ধৈর্য হারাসনি বাপ, বলছি নবীন রায় মারা যাওয়ার পর আমি কেতুগড় ছেড়ে কাজকর্মে বেরিয়ে পড়লাম। বাঁশির সঙ্গে আর সম্পর্ক রইল না।”
ইরফান গাজি গলা নামিয়ে বলল, “ভাই, কিছু মনে কোরো না। তোমার যা কাজ তাতে তো বাঁশিটা হলে তোমার খুব সুবিধে হয়ে যেত, তাই না!”
একটা ফুয়ের শব্দ করে শ্রীনিবাস বলল, “লোককে ঘুম পাড়িয়ে চুরি তো, ও তো লোভী আর আনাড়ি লোকের কাজ। যেমন এই পরাণ দাস। এখনও হাত পায়ের আড় ভাঙেনি, কিন্তু আশা ষোলো আনা। আমাকে কি এলেবেলে চোর পেলে নাকি?”
“আরে না না, ছিঃ ছিঃ!” বলে জিভ কেটে কানে হাত দিল ইরফান। তারপর বলল, “তোমাকে কি আজ থেকে চিনি হে? চুরি তুমি করতে বটে, তবে শিল্পকর্ম হিসেবে। ওটা ছিল তোমার মজা। পেটের ধান্দায় কখনও করোনি। যা রোজগার করেছ তার সবটাই গরিব দুঃখীকে বিলিয়ে দিয়েছ। সব জানি। তুমি একটা সাধারণ চোর হলে এই ইরফান গাজি কি রাত দুপুরে ছুটে আসত তোমার কাছে?”
ফের একটু হাসল শ্রীনিবাস। বলল, “বাঁশি আমি আর দুইনি। বিদ্যেটা শিখেছিলাম ঠিকই, কিন্তু কাজে লাগানোর ইচ্ছেই কখনও হয়নি। তা ছাড়া রাজবাড়ির নুন খেয়েছি, তাদের জিনিস চুরি করে নিমকহারামি করতে পারব না।”
“অতি হক কথা। কিন্তু বাঁশিটা নিয়ে এতদিন বাদে বখেরা বাঁধল কেন?”
‘বাঁধারই কথা। মহানন্দকে তো চেনো?”
“তা চিনব না কেন? নায়েব হরনাথ চৌধুরীর অকালকুণ্ড ছেলেটা তো! খুব চিনি। মহা হারমাদ ছেলে।”
“আমি যখন রিটায়ার হয়ে কেতুগড়ের কাছেই ঘর তুলে বাস করতে লাগলুম তখন মহানন্দ লায়েক হয়েছে। যণ্ডামি গুণ্ডামি করে বেড়ায়। রাজবাড়ির বিস্তর দামি জিনিস চুরি করে বেচে দেয়। রাজা দিগিন্দ্রনারায়ণ বুড়ো হয়েছেন। এখন নিরানব্বই বছর বয়স। একে নিঃসন্তান, তার ওপর রানিমাও গত হয়েছেন। একমাত্র বুড়ো চাকর হরেকেষ্টই যা দেখাশোনা করে। মহানন্দের দৌরাত্ম্য ঠেকানোর সাধ্য বুড়ো রাজার নেই। এমনিতে দিগিন্দ্রনারায়ণ মানুষ খুব ভাল। কিন্তু তাঁর একটা দোষ কী জানো?”
“রাজারাজড়াদের দোষের অভাব কী?”
“সে দোষের কথা বলছি না। তাঁর শুচিবায়ু আছে, ভূতের ভয় আছে, কিপটেমি আছে, কিন্তু সেসব ধরছি না। যে দোষটা সবচেয়ে গুরুতর, তা হল কোনও গোপন কথা পেটে রাখতে পারেন না। কেউ কোনও গোপন কথা বললেই তাঁর ভীষণ অস্বস্তি শুরু হয়ে যায়। যতক্ষণ না কাউকে বলে দিচ্ছেন, ততক্ষণ পেটে বায়ু জমে ঘন ঘন উষ্মার উঠতে থাকে, ক্ষুধামান্দ্য হয়, রাতে ঘুম হয় না, কেবল পায়চারি করেন আর ঘটি ঘটি জল খান আর বিড় বিড় করতে থাকেন। এই জন্য রানিমা পারতপক্ষে তাঁর কাছে কোনও কথা ভাঙতেন না। তা হয়েছে কী, একদিন ঘরদোর ঝাড়পোঁছ করতে গিয়ে হরেকেষ্ট নবীন রায়ের ডায়েরির একখানা পাতা কুড়িয়ে পেয়ে সেটা এনে রাজামশাইকে দেয়। তাতে লেখা ছিল যে, নবীন রায় বাঁশির বিদ্যে আমাকে শিখিয়ে গেছেন। ব্যস, এই খবর জানার পর থেকেই বুড়ো মানুষটার অস্বস্তি শুরু হয়ে গেল। ঢেকুর, পায়চারি, জল, অনিদ্রা, অরুচি, হাই প্রেশার। কাউকে কথাটা না বললেই নয়। একদিন থাকতে না পেরে তাঁর পোষা কাকাতুয়াটাকেই বলে দিলেন, বাঁশির বিদ্যে শ্রীনিবাস জানে। আর হতভাগা কাকাতুয়াটা তারস্বরে সেটা সারাদিন বলতে থাকে। ধূর্ত মহানন্দ আঁচ পেয়ে গিয়ে দিগিন্দ্রনারায়ণের ওপর চড়াও হল। এমনকী তরোয়াল বের করে ভয় দেখাল। দিগিন্দ্রনারায়ণ তখন নবীন রায়ের ডায়েরির পাতাটা তাকে দিয়ে হাঁফ ছেড়ে বাঁচেন।”
“এঃ হেঃ, তা হলে তো বিপদ হল হে!”
“বিপদ তো হলই। তবে রাজামশাইয়ের খুব আত্মগ্লানিও হল। মহানন্দ যখন দলবল নিয়ে গোটা এলাকায় আমাকে খুঁজে বেড়াচ্ছে তখন রাজামশাই গোপনে হরেকেষ্টকে দিয়ে আমাকে ডাকিয়ে আনিয়ে হাউমাউ করে আমার হাত ধরে বললেন, তোর কাছে বড় অপরাধ করে ফেলেছি রে। মহানন্দ তোর ওপর বড় অত্যাচার করবে, তারপর দেশ ছারখার করতে শুরু করবে। তা তুই আমার মুখ রক্ষে কর। মহানন্দ বাঁশি কড়া পাহারায় রেখেছে। ও বাঁশি তোকে চুরি করতে হবে। বাঁশি নিয়ে তুই দূরে কোথাও পালিয়ে যা।তা আমি বললুম, মহারাজ, আমি যে রিটায়ার হয়েছি। বয়সও হল। মহারাজ বললেন, বুড়ো হলে কী হয়, এ তোর বাঁ হাতের কাজ। আমি তোকে এ কাজের জন্য মজুরিও দেব। আমাকে বাঁচা, রাজি হয়ে যা।”