“তাই তো বলছি রে, বাঁশি লোপাট হওয়ার মানে বুড়োটার বিপদ বাড়ল। এখন গুণ্ডা দুটো যদি তাকে খুঁজে বের করে চড়াও হয় তা হলে কি সে ঠেকাতে পারবে? ধর যদি গলায় ছোরা বাগিয়ে ধরে তবে হয়তো বাঁশি বাজানোর কায়দাকানুন শিখিয়েই দিল ভয় খেয়ে।”
পরাণ ফের উত্তেজিত হয়ে বলে, “তা হলে তো সাড়ে সর্বনাশ! ওস্তাদ, তাকে তো এখনই হুঁশিয়ার করা দরকার।”
মাথা নেড়ে শ্রীনিবাস একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলে, “হুঁশিয়ার করেই বা লাভ কী বল! তার কি আর পালানোর জায়গা আছে!”
পরাণ শ্রীনিবাসের এই হালছাড়া ভাব দেখে মোটেই খুশি হল না। বলল, “কিন্তু একটা কিছু তো করা দরকার ওস্তাদ।”
“তাই তো করছি।”
“কী করছেন ওস্তাদ? মাথায় ফন্দি এল কিছু?”
“এল বইকী। ফন্দিটা এখন বঁড়শির টোপে ঠোকরাচ্ছে। একটু খেলিয়ে তুলতে হবে। সেইজন্যই তো গরম ভাত দিয়ে কাঁচা লঙ্কা টেসে লাউপোস্তটা খাওয়া দরকার। তা হলেই দেখবি ফন্দিটা কপ করে টোপ গিলে লেজ নাড়তে নাড়তে উঠে এসেছে।”
“কিন্তু বুড়োটা কে ওস্তাদ?”
“আছে রে আছে। ধারেকাছেই আছে। কিন্তু সবার আগে লাউপোস্ত।”
পরাণ কাহিল হয়ে হাল ছেড়ে বলল, “তবে লাউশোস্তই হোক।” কিন্তু খেতে বসেও ভারী আনমনা রইল শ্রীনিবাস। যেমনটা খাওয়ার কথা তেমনটা খেল না। পাতে খানিক ফেলে গম্ভীর মুখে উঠে পড়ল। মাদুরে শোওয়ার পর পরাণ তার গা-হাত খানিক দাবিয়ে দিয়ে নিজেও মাদুরের একধারে শুয়ে ঘুমিয়ে পড়ল।
মাঝরাতে হঠাৎ দরজায় খুট খুট শব্দ। চাপা গলায় কে যেন ডাকল, “শ্রীনিবাস! ও শ্রীনিবাস!”
অভ্যাসবশে পরাণ চট করে হামাগুড়ি দিয়ে মাচার নীচে ঢুকে যাচ্ছিল। শ্রীনিবাস তার কাছা টেনে ধরে একটা হাই তুলে বলল, “ভয় নেই। দরজাটা খুলে দে।”
আতঙ্কিত পরাণ বলে, “দেব? তারা নয়তো!”
“বুড়ো বয়সের দোষ কী জানিস?”
পরাণ রেগে গিয়ে বলে, “জানব না কেন? বুড়োরা কানে কম শোনে, চোখে কম দেখে, বুদ্ধি কমে যায়, মাঝরাতে হুট করে দরজা খুলে দেয়।”
এক গাল হেসে শ্রীনিবাস বলে, “তা ঠিক। তবে বুড়োদের পুরনো কথা মনে থাকে। যা দরজাটা খুলে দে। ও আমার পুরনো বন্ধু ইরফান গাজি।”
পরাণ দরজা খুলতেই ইরফান গাজি টুক করে ঢুকে দরজাটা বন্ধ করে দিল। তার এক হাতে টর্চ অন্য হাতে লাঠি।
শ্রীনিবাস উদাত্ত গলায় বলল, “এসো ইরফান। কতকাল পরে দেখা।”
ইরফান গাজি এসে শ্রীনিবাসের হাত দুটো ধরে ফেলে বলল, “আমার চোখ দুটো এখনও ভাল আছে, বুঝলে? আবছা আলোতে মিটিং-এর এক কোণে তোমাকে বসে থাকতে দেখেই চিনেছি। মনে হল, ও বাঁশি চুরির ব্যাপারের সঙ্গে তোমার একটা যোগ আছে। তাই পাঁচজনের সামনে আর চেনা দিইনি।”
.
দাড়ি-গোঁফের ফাঁকে একটু হেসে শ্রীনিবাস বলল, “ভালই করেছ। লোকজনের নজরে বেশি না পড়াই ভাল। কিন্তু আমার খোঁজ পেলে কী করে?”
“বদরুদ্দিন নামে আমার একটা চাকর আছে। আসলে সে চাকর সেজে থাকে। খুব সেবা টেবা করে। সে কিন্তু বড়লোকের ছেলে, চাকর সেজে আমার বাড়িতে ঢুকেছে চুরি করে বাঁশি শিখবে বলে। বড়লোকের ছেলের তো নানা খেয়াল হয়, তাই বদরুদ্দিন জীবনে অনেক কিছুই হতে চেয়েছিল। সাপুড়িয়া হবে বলে বাড়ি থেকে পালিয়েছিল, যাত্রার দলে ভিড়েছিল, চোর হওয়ার জন্য ষষ্ঠী গুণের কাছে তালিম নিয়েছিল।”
পরাণ হাতজোড় করে মাথায় ঠেকিয়ে বলল, “আমার পূজ্যপাদ শ্বশুরমশাই।”
ইরফান বলল, “সেই বদরুদ্দিনকে কাজে লাগাতেই খবর নিয়ে এল। তল্লাটের সব চোরকেই সে চেনে কিনা। তা তোমার ব্যাপারখানা কী বলল তো! বাঁশির সন্ধানে বেরিয়েছ নাকি?”
একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে শ্রীনিবাস গম্ভীর গলায় বলল, “সে এক লম্বা কাহিনী ভাই। মোহন রায়ের অধস্তন চতুর্থ পুরুষ নবীন রায়ের কাছে তুমিও কিছুদিন তালিম নিয়েছিলে।”
“তা আর নিইনি! তারপর তো বেনারসের আমানুল্লা খাঁ সাহেবের সঙ্গে সঙ্গ করতে চলে যাই, নবীন বাবার কাছে আর শেখা হল না।”
“আমি কিছুদিন বেশি শিখেছিলুম। নবীন রায় একদিন আমাকে ডেকে বললেন, দেখ শ্রীনিবাস, মোহন রায়ের বাঁশি এক সর্বনেশে জিনিস। বংশপরম্পরায় আমরাই শুধু ও বাঁশি বাজাতে জানি, আর কেউ জানে না। আমার ছেলেপুলে নেই, সুতরাং আমি মরলে পরে ও বিদ্যে লোপ পাবে। কিন্তু মুশকিল কি জানিস, বিদ্যেটা কেবলমাত্র আমিই জানি বলে, আমার মনে হয়, মরার পরও আমার প্রাণটা ওই বাঁশিটার কাছে ঘোরাফেরা করবে, আমার আর মুক্তি হবে না।
মন্ত্রশক্তি জিনিসটা বড় ভয়ংকর। তাই ঠিক করেছি ও বিদ্যে আমি তোকেই শিখিয়ে যাব।”
ইরফান উত্তেজিত হয়ে বলে, “বলো কী হে!”
“আমিও ঘাবড়ে গিয়ে বললাম, ও বাবা, ও আমি শিখব না।’ নবীন রায় বললেন, ‘তোকে ভাল করে জানি বলেই বিশ্বাস করি তুই কোনও অকাজ করবি না। দেখ বাঁশির বিদ্যে কাউকে দিয়ে খালাস হতে না পারলে আমার মুক্তি হবে না। কাউকে শেখাতে পারলেই আমার ছুটি।”
“শিখলে নাকি?”
“হ্যাঁ, রাজবাড়ির মাটির নীচে একটা নিরেট ঘরের সব রন্ধ্র ভাল করে বন্ধ করে দিয়ে সাতদিন ধরে নিশুত রাতে নবীন রায় আমাকে বাঁশিটা বাজাতে শিখিয়ে দিলেন। শেখানোর সময় আমার কানে তুলো এঁটে দিতেন, যাতে সুরটা কানে না শুনতে পাই। যে বাজায় তার ওপর বাঁশি কোনও ক্রিয়া করে না, কিন্তু যে শোনে তার ক্রিয়া হয়।”