ষষ্ঠী গুণের মেয়ের কাছে নিত্যি হেনস্তা হতে হচ্ছে বলে একদিন সে নিজের বাজারদরটা যাচাই করতে পুলিশের ইনফর্মার নবুদাদার কাছে গিয়েছিল। পরগনার সমস্ত চোরছ্যাঁচড়ার খবর নবুদাদার নখদর্পণে। গিয়ে পেন্নাম করে বলল, “নবুদাদা, পুলিশের খাতায় কি আমার নামে খারাপ কিছু লেখা আছে? মানে কেউ নালিশটালিশ কিছু করে রেখেছে কি না তাই জানতেই আসা।”
নবু ভারী অবাক হয়ে বলল, “কেন রে, তোর নামে নালিশ করবে কেন? কী করেছিস তুই?”
ঘাড়টাড় চুলকে ভারী লজ্জার সঙ্গে পরাণ বলল, “ওই রাতবিরেতে কাজকর্ম আর কী?”
নবু আরও অবাক হয়ে বলে, “চোর নাকি তুই!”
“যে আজ্ঞে।”
“নামটা বল তো, লিস্টিটা দেখি।”
“আজ্ঞে পরাণ দাস।” নবু একখানা লম্বা খাতা বের করে ভ্রু কুঁচকে বিড় বিড় করে বলতে লাগল, “বদন মণ্ডল, পাঁচু গড়াই, গেনু হালদার, খগেন দুলে… দাঁড়া প-এর পাতাটা দেখি। এই তো পবন সাঁতরা, পতিতপাবন কোঙার, পীতাম্বর দাস… নাঃ, পরাণ দাসের নাম তো নেই।”
ভারী হতাশ হয়ে পরাণ বলল, “নেই?”
“না। চুরি করিস অথচ আমার খাতায় নাম ওঠেনি এ আবার কেমন ব্যাপার! তা কী চুরি করিস বল তো! বড় কাজটাজ কিছু করেছিস?”
পরাণ ভারী লাজুক মুখে ঘাড় হেঁট করে বলল, “নিজের মুখে কী আর বলব। গত মাসে রায়বাড়ি থেকে কিছু বাসনপত্র সরিয়েছিলাম, সপ্তাহ দুয়েক আগে ঘোষবাড়িতে সিঁদ দিয়ে চারখানা শাড়ি, তিনটে ধুতি আর একটা পেতলের গামলা পাই। গেল হপ্তায় মদন ময়রার দোকানে ক্যাশবাক্স ভেঙে তিপ্পান্ন টাকা ষাট পয়সা আর দু’হাঁড়ি দই রোজগার হয়। দিন তিনেক আগে–”
নবু নাক সিঁটকে হাত তুলে তাকে থামিয়ে দিয়ে বলল, “তাই বল! তুই এখনও শিক্ষানবিশ! সেইজন্যই আমার লিস্টিতে নাম ওঠেনি। তার জন্য মন খারাপ করিসনি, মন দিয়ে কাজ কর। নিষ্ঠা থাকলে, পরিশ্রম করলে নাছোড়বান্দা হয়ে লেগে থাকলে একদিন উন্নতি হবেই, দেখে নিস। চরিত্র চাই রে, চরিত্র চাই। মনটাকে শক্ত করে লেগে যা।”
নবুদাদার কাছে ও কথা শোনার পর মরমে মরে ছিল পরাণ। এখন শ্রীনিবাস চূড়ামণির দেখা পাওয়ার পর মেঘলা আকাশে যেন সূর্যের মুখ উকিঝুঁকি মারছে। আবার গগনে যেন সুধাংশু উদয় রে।
মিটিং ভেঙে গেছে অনেকক্ষণ। গাঁয়ের লোকেরা সব লাঠিসোঁটা নিয়ে গ্রাম টহল দিতে বেরিয়ে পড়েছে। অন্ধকার মাঠের একটা কোণে তবু গুম হয়ে বসে আছে শ্রীনিবাস চূড়ামণি। পাশে বশংবদ পরাণ। বারকয়েক ডেকেও সাড়া না পাওয়ায় পরাণও এখন চুপ মেরে গেছে। মাঝে-মাঝে শুধু চটাস-পটাস করে মশা মারছে। সে বুঝতে পারছে চূড়ামণির এখন ধ্যানস্থ অবস্থা। এই ধ্যানটা অনেকটা ডিমে তা দেওয়ার মতো। তারপর একসময়ে ধ্যানের ডিমটা ফেটে ফন্দিফিকির পিল পিল করে বেরিয়ে আসবে।
বেশ কিছুক্ষণ গুম হয়ে থাকার পর শ্রীনিবাস একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলল। তারপর বলল, “চল।”
“যে আজ্ঞে!” বলে উঠে পড়ল পরাণ, হ্যাঁ, এইবার ডিম ফেটেছে বলেই মনে হচ্ছে। সে সোৎসাহে জিজ্ঞেস করল, “কোথায় যেতে হবে ওস্তাদ?”
“কেন, তোর বাড়িতে! গরম ভাতে একটু কাঁচালঙ্কা ডলে লাউশোস্ত খেয়েছিস কখনও? ওরে, সে জিনিস মুখে দিলে মনে হবে অমরাবতীতে পৌঁছে গেছি।”
পরাণের মুখ শুকিয়ে গেল। সে একটা ঢোক গিলে বলল, “আপনি কি এতক্ষণ গুম হয়ে বসে লাউপোন্তর কথা ভাবছিলেন নাকি?”
“তা ছাড়া আর ভাববার আছেটা কী?”
“কিন্তু বাঁশিটা যে বদমাশদের হাতে গিয়ে পড়ল তার কী হবে? তারা যে পগার পার হয়ে গেল এতক্ষণ!”
“আহা, গুণ্ডা-বদমাশরা দূরে থাকলেই তো ভাল। তাদের সঙ্গে গা ঘষাঘষি করার দরকারটা কী আমাদের?”
পরাণ উত্তেজিত হয়ে বলল, “কিন্তু ওস্তাদ, বাঁশিটা হাতছাড়া হলে আমাদের আর রইলটা কী? বড় আশায় আশায় ছিলাম, বাঁশিটা পেলে সবাইকে ঘুম পাড়িয়ে নিশ্চিন্তে কাজকারবার বাগিয়ে নেব। বেশি কিছু নয় ওস্তাদ, একখানা পাকা দোতলা বাড়ি, পনের-বিশ বিঘে ধানী জমি, দুটো দুধেল গাই, বউয়ের গায়ে দু চারখানা সোনার গয়না, আর ধরুন আমার একখানা আলপাকার কোট আর সাহেবি টুপির বড় শখ। দজ্জাল বউটার মুখের মতো একখানা জবাব দিতে পারতুম তা হলে। মুখনাড়া দিতে এলেই এক বান্ডিল নোট ছুঁড়ে দিতুম পায়ের কাছে, তা হলেই মুখে কুলুপ। তা সেই আশায় কি লাল সিগন্যাল পড়ে গেল ওস্তাদ? লেভেল ক্রসিং এর গেট কি বন্ধ হয়ে গেল?নটী বিনোদিনীর পার্ট করতে করতে কি হিরোইনের বাঁধানো দাঁত খসে পড়ে গেল? নাকি শ্রীরাধিকার অভিসারের পথে আয়ান ঘোষ গদা ঘোরাতে ঘোরাতে মুলোর মতো দাঁত বের করে বুক চিতিয়ে এসে দাঁড়াল?”
“বলি, বাঁশির জন্য বড় লাতন হয়ে পড়লি যে! বাঁশি গেছে যাক, সেজন্য অত ভাবনা নেই। কিন্তু এখন যে ওই বাঁশি বাজানোর জন্য একজন উপযুক্ত বেঁশোও দরকার, সে খেয়াল আছে তোর?”
একগাল হেসে পরাণ বলে, “বেঁশো মানে বাঁশিয়াল তো! সে মেলাই আছে।”
ঘন ঘন মাথা নাড়া দিয়ে শ্রীনিবাস বলে, “ও বাঁশি বাজানোর এলেম মাত্র একটি লোকেরই আছে। বুড়ো মানুষ রে। এখন তার খোঁজ হবে। আর বুড়ো বয়সের দোষ কী জানিস?”
“কী ওস্তাদ?”
“বুড়ো বয়সে মানুষের প্রাণের মায়া বাড়ে, ভয় বাড়ে, মনের জোর কমে যায়।”
“আজ্ঞে, তা আর জানি না! বুড়ো বয়সে বাতব্যাধি বাড়ে, খাই-খাই বাড়ে, বাইবাতিক বাড়ে, আক্কেল কমে যায়।”