গঙ্গারাম রায়ের বাড়ির দাওয়ায় দুটো লোক মাদুর পেতে ঘুমোচ্ছিল। বিশু পালের দল তাদের দেখতে পেয়েই পা টিপে টিপে গিয়ে ঘিরে ফেলল। টর্চ ফোকাস করে দেখা গেল, তারা কেউ গাঁয়ের চেনা লোক নয়। সঙ্গে সঙ্গে বিশুর দল লাঠিসোঁটা নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়ল তাদের ওপর। লোক দুটো আচমকা হামলায় উঠে হাউরেমাউরে চিৎকার।
গঙ্গারাম তাড়াতাড়ি বেরিয়ে এসে বলল, “করো কী, কয়রা কী তোমরা! ওঁরা যে আমার পিসেমশাই আর মেলোমশাই! বুড়ো মানুষ ঘরে গরম হচ্ছিল বলে বারান্দায় শুয়েছেন।”
বিশু পাল অপ্রস্তুত হলেও মারমুখো ভাবটা বজায় রেখেই বলল, “পিসেমশাই আর মেসোমশাই বললেই তো হবে না। প্রমাণ কী?”
এই সময়ে গঙ্গারামের পিসি আর মাসি একজন হাতে রুটি বেলার বেলুন, আর একজন ঘাস কাটার হেঁসো নিয়ে বেরিয়ে এসে সপ্তমস্বরে চেঁচাতে লাগল, “প্রমাণ! দেখাচ্ছি তোমার প্রমাণ। হতভাগা, বোম্বেটে, গুণ্ডা, আজ তোদেরই একদিন কি আমারই একদিন…।”
অগত্যা বিশু পাল আর তার দলবলকে পিছু হটতে হল।
নয়নচাঁদের বারান্দায় একটা লোক বসে বসে গুনগুন করে রামপ্রসাদী ভাঁজছিল। রাখাল মোদকের দল গিয়ে যখন তাকে পেড়ে ফেলল তখন লোকটা কাঁদো কাঁদো হয়ে বলল, “আমি যে নয়নবাবুর মেজোজামাই। গোবিন্দপুরে বিরিঞ্চি মহাজনের গদিতে বিষয়কর্মে আসা। ফিরতে রাত হয়ে গেল বলে শ্বশুরবাড়িতে রাতটা কাটাতে এসেছি। এসে দেখি ঘর তালাবন্ধ। বাড়িসুষ্ঠু তোক নাকি পাশের গাঁয়ে যাত্রা শুনতে গেছে। তাই বসে আছি মশাইরা, আমি চোর ডাকাত নই।”
কিন্তু কে শোনে কার কথা, সবাই এই মারে, কি সেই মারে।
লোকটা কাঁদো কাঁদো হয়ে বলল, “গণ্ডগ্রামের কথা শুনেছি মশাই, কিন্তু গুণ্ডাগ্রামের কথা জানা ছিল না। এই নাক মলছি, কান মলছি, জীবনে আর কখনও শ্বশুরবাড়িমুখো হব না।”
গোলমাল শুনে পাশের বাড়ি থেকে পাঁচকড়ি নস্কর বেরিয়ে এসে বলল, “তোমাদের আক্কেলখানা কী হে, এই তো সেদিন নয়নচাঁদের মেজো মেয়ের বিয়েতে এসে তোমরা গাঁসুদু লোক গাণ্ডেপিণ্ডে গিলে গেলে। ওই রাখাল বিশ্বাস বাইশখানা মাছ খেয়েছে, এই কালীপদ সেদিন একান্নটা রসগোল্লা সাঁটিয়েছিল, আর ওই যে সত্যগোপালের চেলা প্যাংলাচরণ এখন মুখ লুকোচ্ছে, এটি অন্তত সেরটাক খাসির মাংস গিলেছিল। যার বিয়ের ভোজে কাছা খুলে খেয়েছিলে আজ তাকে দেখেও চিনতে পারছ না, নেমকহারাম আর কাকে বলে!”
রাখাল মোদক আমতা আমতা করে বলল, “জানোই তো ভাই, আমি বোকাসোকা মানুষ। একটা ভুল হয়েছে, মাপ করে দাও।”
পাঁচকড়ি হেঁকে বলল, “যে গাঁয়ে জামাইয়ের হেনস্থা হয় সে গাঁয়ে আর কোনও জামাই আসতে চাইবে? এ যা করলে তোমরা, এরপরে এ গাঁয়ের মেয়ে বিয়ে করতেও আর কোনও জামাই বাবাজীবনের আগমন ঘটবে না। কী সর্বনাশটা হবে একবার ভেবে দেখো। ঘরে ঘরে আইবুড়ো মেয়েরা বসে বসে বুড়ি হয়ে যাবে।”
ভয় পেয়ে সবাই মিলে নয়নচাঁদের জামাইকে তাড়াতাড়ি খুব খাতিরটাতির করে রাখালের বাড়িতে নিয়ে গিয়ে ভোজের আয়োজন করে ফেলল। নরম বিছানাটিছানা পেতে দিল।
ভজুরাম আর গজুরাম নয়াগঞ্জের মাড়োয়াড়ি মহাজনের পাইক। তিন গাঁ ঘুরে তাগাদা সেরে রাতের দিকে ময়নাগড়ের বাঁশবনের পাশ ঘেঁষেই দুই পালোয়ান ফিরছিল। এমন সময় রে রে করে ডাক্তার প্রভঞ্জনের দলবল তাদের ওপর গিয়ে চড়াও হল। ব্রজ কবরেজ চেঁচিয়ে উঠল, “হ্যাঁ, হ্যাঁ, এই দুজনই তো! ঠিক চিনেছি।” হোমিও নগেনও দৃঢ়তার সঙ্গে বলল, “হুবহু সেই মুখ, সেই চোখ।”
সবাই মারমার করে যখন ঘিরে ফেলল তাদের তখন দু’জনে খানিক অবাক হয়ে তাদের দিকে চেয়ে রইল। ভজুরাম বলল, “এ হো গজুয়া, ইন লোক ক্যা কহতানি রে?”
“মালুম নেহি ভাই। এক এক কো উঠাকে পটক দে।”
প্রভঞ্জন দুজনের রোখাভাব আর বিশাল চেহারা দেখে গম্ভীর গলায় বলল, “না, না, এরা নয়। তোমাদের ভুল হয়েছে।”
ব্রজ কোবরেজও সায় দিল, “না, এরা তো তেমন খারাপ লোক বলে মনে হচ্ছে না। হ্যারিকেনের আলোতে ভাল বোঝা যাচ্ছিল না বটে।”
নগেন মিনমিন করে বলল, “আমিও তো পইপই করে বলেছিলাম এরা হতেই পারে না। তারা ছিল অন্যরকম লোক।”
ভজুরাম আর গজুরাম হেলতে দুলতে চলে গেল।
.
কাঁঠালতলার ভূতটাকে দেখার পর থেকেই শ্রীনিবাস একটু গুম মেরে গেছে। ওস্তাদের মুখচোখের ভাব দেখে পরাণ তাকে বেশি ঘাঁটাচ্ছে না। ওস্তাদ মানুষেরা যখন চুপ মেরে থাকে তখন তাদের মাথায় নানা ভাল ভাল মতলবের খেলা চলতে থাকে। অনেকটা রান্নাবান্নার মতোই। গরম তেলে ফোড়ন পড়ল, মশলা পড়ল, তারপর ব্যাঞ্জন কি মাছ কি মাংস জারানো হতে লাগল। সব মিলে মিশে যে জিনিসটা বেরিয়ে এল সেটাই আসল।
ওস্তাদের সঙ্গে কয়েকদিন থেকে পরাণ নিজের খামতিগুলো আরও বেশি টের পাচ্ছে। এই যে ওস্তাদ কাঁঠালতলায় ভূতটাকে দেখতে পেল, কিন্তু সে পেল না। তার মানে পরাণের চোখ এখনও তৈরি হয়নি। তৃতীয় নয়ন না থাকলে হবেই বা কী করে? রাতবিরেতে সে তো আলায় বালায় ঘোরে, ভূতবাবাজিরা কি আর তখন হাঁটাহাঁটি করে না? কিন্তু ওই তিন নম্বর চোখটার অভাবে আজ অবধি তাদের কারও দেখাই পেল না সে। তার যা কাজ তাতে এক-আধজন ভূতপ্রেত হাতে থাকলে সুলুক সন্ধান পেতেও সুবিধে হয়।
নিজের অযোগ্যতার জন্য ভারী মনমরা হয়ে থাকতে হয় পরাণকে। নয়নতারার গঞ্জনায় জীবন আরও অতিষ্ঠ। তার কপালদোষে নয়নতারা আবার ষষ্ঠী গুণের মেয়ে। সেই ষষ্ঠী গুণ, ঝিকুড়গাছার আশপাশের দশটা গাঁয়ের চোর বাটপাড়েরা যার নাম শুনলে হাতজোড় করে কপালে ঠেকায়, গুণীর মেয়ে তো, তাই তাকে চোর বলেই গণ্য করে না। কথা উঠলে বলে, “তুমি তো এখনও চুরিতে হামাদেওয়া শিশু।”