“আজ্ঞে, কথাটা শোনা শোনা ঠেকছে। এই যেমন আপনি আমার পাশে, সেই পাশ কি?”
“আরও একটু গভীর। পাশ মানে বন্ধন। নিদ্রাপাশ মানে ঘুমের বন্ধন। খুব আঁট করে ঘুমের দড়িতে সবাই বাঁধা পড়বে। বুঝলি?”
“এ তো বড় ভাল জিনিস ওস্তাদ। সবাইকে যদি ঘুম পাড়িয়ে ফেলা যায় তা হলে তো আমাদের একেবারে খোলা মাঠ। চেঁছেপুঁছে আনা যাবে। এক রাতেই রাজা।”
“অত লাফাসনি। যারা বাঁশি কেড়ে নিয়ে গেছে তারাও ওই মতলবেই নিয়েছে।”
“আর তিন নম্বর স্থাদা?”
“সেটা ওই তুই যা বললি। ঘূর্ণি ঝড় বা বান বা ভূমিকম্প। সাঁটেও তাই বলা আছে। তিনে সর্বনাশ। তাই যার-তার হাতে ও জিনিস গেলে বড় বিপদের কথা।”
“তা হলে আমরা আর দেরি করছি কেন ওস্তাদ?”
“তুই এক্ষুনি তেড়েফুঁড়ে উঠে একটা কিছু করতে চাস বুঝতে পারছি। কিন্তু মনে রাখিস সবুরে মেওয়া ফলে। বাঁশিচোর কি তোর হাতে ধরা দেবে বলে দু’হাত বাড়িয়ে বসে আছে? তার ওপর ভেবে দ্যাখ, সেই গুণ্ডাটা যদি চড়াও হয় তা হলে এই ল্যাকপ্যাকে শরীর নিয়ে লড়াই দিতে পারবি কি না।”
উঠতে গিয়েও ফের বসে পড়ল পরাণ। বলল, “যতই যাই করতে যাই আপনি কেন যে তাতে জল ঢেলে দেন কে জানে।”
“হুটপাট করে কাজ পণ্ড করার চেয়ে মাথা ঠাণ্ডা করে চিন্তা করা ভাল। কাজের পিছনে চিন্তা হল ছেলের পিছনে মা।”
একগাল হেসে পরাণ বলল, “এবার বুঝেছি। যেমন ডালের পিছনে শুকতো, দুইয়ের পিছনে এক, হাতের পিছনে বগল, রামের পিছনে রামায়ণ, মুর্গির পিছনে ডিম, সওদার পিছনে পয়সা, কাশীর পিছনে গয়া, দইয়ের পিছনে দুধ, ভেঁকুরের পিছনে ভোজ…”।
“ওরে ক্ষ্যামা দে। যথেষ্ট হয়েছে। জলের মতো বুঝেছিস।”
“বলছিলুম না আপনাকে, মাথা থেকে গোবরের গন্ধটা গায়েব হয়েছে!”
“তা তো হয়েছে, এখন বল তো, পিছনে ওই কাঁঠালতলায় ঘাপটি মেরে অনেকক্ষণ ধরে চুপ করে বসে আছে, ওই লোকটা কে!”
পরাণ ঘাড় ঘুরিয়ে দেখে নিয়ে বলল, “কোথায় কে? জোনাকি পোকা ছাড়া আর তো কিছু দেখা যাচ্ছে না ওস্তাদ!”
“তুই কি বলতে চাস, আমি ভুল দেখছি? বারবারই আমার চোখ চলে যাচ্ছে ওইদিকে। ওই দ্যাখ না, একটা সাদাটে জোব্বামতো পরা… ওই যে এইমাত্র উঠে দাঁড়াল, দেখেছিস?”
পরাণ ফের ঘাড় ঘুরিয়ে ভাল করে দেখে বলল, “আমি তো কিছু দেখতে পাচ্ছি না ওস্তাদ!”
শ্রীনিবাস একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল, “চলে গেল!”
পরাণ চিন্তিত হয়ে বলল, “ওস্তাদ, চোখে ছানিটানি পড়েনি তো! ছানি হয়ে থাকলে তো খুবই দুশ্চিন্তার কথা। কাজকারবার হবে কী করে?”
শ্রীনিবাস গম্ভীর মুখে বলে, “ছানি নয় রে, দূরদৃষ্টি, যা দেখেছি ঠিকই দেখেছি। ও জিনিস তোর দেখার নয়। দেখতে যে পাসনি তাতে ভালই হয়েছে।”
শশব্যস্তে পরাণ বলল, ‘জিনিসটা কী ওস্তাদ? সেই জিনিস নাকি, সন্ধের পর যার নাম করতে নেই? রাম রাম রাম রাম…”
“কিছু একটা হবে। এখন বাড়ি চল তো। বউমাকে আজ লাউ পোস্ত রাঁধতে বলে এসেছি। বুড়ো বয়সে আমার একটু নোলা হয়েছে। ভিতরটা কেবল খাই খাই করে।”
“আজ্ঞে, সে আমারও করে।”
“কিন্তু তা বলে ঠেসে খাসনে। আজ রাতে একটু কাজে বেরোতে হবে। কাজের সবচেয়ে বড় শত্রু হল খাওয়া। বুঝেছিস?”
“তা আর বুঝিনি! চোরের শত্রু পুলিশ, ওলের শত্রু তেতুঁল, জোঁকের শত্রু নুন, ধারের শত্রু সুদ, কালীর শত্রু কেষ্টঠাকুর, বরের শত্রু বউ, খিদের শত্রু ভাত…।”
“বুঝেছি; বুঝেছি! এখন পা চালিয়ে চল তো।”
“যে আজ্ঞে।”
৪. সভায় সিদ্ধান্ত হল
সভায় সিদ্ধান্ত হল গাঁয়ের লোকেরা চার-পাঁচটি দলে ভাগ হয়ে চারদিকে লোক দুটোকে খুঁজে বেড়াবে। সেইসঙ্গে সারা রাত গাঁ পাহারাও দেবে। এসব কাজে সত্যগোপাল সর্বদাই নেতৃত্ব দিয়ে থাকে। কে কোন দলে থাকবে তাও সে ঠিক করে দিল। তাই নিয়ে অবশ্য খানিক গণ্ডগোল হল। যেমন ছকু দাসের সঙ্গে কালীপদর ঝগড়া, তাই কালীপদ ছকুর দলে যেতে নারাজ। মনোরঞ্জন কম্পাউন্ডারের গোরুকে বিশু পাল খোঁয়াড়ে দিয়েছিল বলে মনোরঞ্জন বিশু পালের দলে যেতে রাজি নয়। তার বাবার অসুখ হওয়ায় হারাধন প্রভঞ্জন ডাক্তারকে ডাকতে গিয়েছিল, কিন্তু প্রভঞ্জন তবু তাকে ইনজেকশন দিয়েছিল বলে হারাধনের রাগ এখনও যায়নি, তাই ডাক্তারবাবুর দলে সে গেল না। ইত্যাদি।
বিষ্ণুরাম বলল, “দেখুন, আমিই হলাম এখানে সরকারের প্রতিনিধি। আইন শৃঙ্খলার কর্তা, সংক্ষেপে বলতে গেলে, আমিই ময়নাগড়ের সরকার। আমার ওপর বিরাট দায়িত্ব। আমি আক্রান্ত হওয়া মানে সরকার আক্রান্ত হওয়া। আমার পতনের মানে সরকারের পতন। আমার ধরাশায়ী হওয়া মানে সরকারের ধরাশায়ী হওয়া। সুতরাং আমাকে খাড়া থাকতে হবে। সুস্থ ও নিরাপদ থাকতে হবে। আমার ভাল থাকা মানে সরকারের ভাল থাকা। তাই আমি বাড়ি যাচ্ছি। কোনও বিপদ ঘটলে আপনারা সাহসের সঙ্গে মোকাবিলা করবেন। জানবেন, আমি অর্থাৎ সরকার আপনাদের পিছনেই আছি।” ইত্যাদি।
হ্যাজাক, লণ্ঠন, টর্চ ইত্যাদি নিয়ে দলে দলে লোক বেরিয়ে পড়ল। কারও হাতে লাঠি, কারও বা দা, কারও হাতে কুড়ুল বা শাবল। যে যা অস্ত্র পেয়েছে নিয়ে বেরিয়ে পড়েছে। পঞ্চাননের হাতে ঝটা দেখে গঙ্গারাম প্রশ্ন তোলায় পঞ্চানন বলল, “ঝাটাটাকে তুচ্ছ ভেবো না ভাই, আমার গিন্নির হাতে এই ঝাঁটার কেরামতি তো দ্যাখোনি। আমার বিশ্বাস ঝাঁটা দিয়ে সে বাঘও মারতে পারে।”