বটেশ্বরকে চমকে দিয়ে ঠিক এই সময়ে কাছের আমগাছ থেকে একটা পাখি পরিষ্কার ইংরিজিতে বলে উঠল, “ডু ইট! ডু ইট! ডু ইট!”
সত্যিই বলল নাকি? না, ও তার শোনার ভুল! পাখি কতরকম ডাক ডাকে। ওরা তো আর ইংরেজি জানে না।
তবু ডাকটা নিয়তির নির্দেশ বলেই কেন যেন মনে হচ্ছিল তার। কে জানে বাপু, দুনিয়ায় কত অশৈলী কাণ্ডই তো ঘটে। তাই বটেশ্বর সাবধানে চারপাশটা একটু দেখে নিল। না, কেউ কোথাও নেই। থাকার কথাও নয়। কেউ দেখে ফেললে লজ্জার ব্যাপার হবে। একা একাও তার লজ্জা করছে। নিজের কাছেও কি মানুষ লজ্জা পায় না? দোনামেমানা করে সে বলে উঠল, “চেষ্টা করব?”
অমনি কালীদহের মোটাসোটা পুরনো ব্যাঙগুলোর একটা জলের কাছ থেকে মোটা গলায় বলে উঠল, “লজ্জা কী? লজ্জা কী? লজ্জা কী?”
ফের বটেশ্বর চমকাল। নাঃ, নিয়তি আজ যেন চারদিক থেকে তাকে হুকুম দিচ্ছে। খুবই লাজুক মুখে আড়বাঁশিটা তুলে সে খুব জোরে একটা ফুঁ দিল। বলাই বাহুল্য, কোনও আওয়াজ বেরোল না। শুধু ফস করে খানিকটা বাতাস বেরিয়ে গেল। বড় লজ্জা পেয়ে ক্ষান্ত হল বটেশ্বর।
কাছেই ভাঙা শিবের দেউল। দেওয়াল কেটে একশো অশ্বত্থ গাছ গজিয়েছে। সেখান থেকে একটা তক্ষক বলে উঠল, “চেষ্টা করো! চেষ্টা করো! চেষ্টা করো!”
বটেশ্বর অবাক থেকে অবাকতর হচ্ছে। এসব কি ছদ্মবেশী দৈববাণী নাকি? চতুর্দিকে কি একটা অলৌকিক ষড়যন্ত্র চলছে? বাঁশিওলা বলেছিল বটে যে, বাঁশিতে ভর হয়। তা হলে কি তার মতো আনাড়ির ফুয়ে বাঁশি বেজে উঠবে?।
একটু ভরসামতো হল বটেশ্বরের। আরও বার কয়েক ফুঁ দিয়ে দেখল সে। না, শুধু ফস ফস করে হাওয়া বেরোল, আওয়াজ হল না। হতাশ হয়ে সে চুপ করে বসে রইল।
বিমর্ষ মনে বাড়ি ফিরে বাঁশিটা গোয়ালঘরে যথাস্থানে রেখে বটেশ্বর যখন ঘরে ঢুকল তখন তার বউ বলল, “ওগো, আজ সন্ধেবেলায় দুটো লোক তোমার খোঁজে এসেছিল।”
“তারা কারা?”
“কে জানে, চেনা লোক নয়। একজন খুব লম্বাচওড়া, আর একজন কেমন যেন শকুন, শকুন চেহারা।”
“কী দরকার তাদের?”
“শকুনের মতো লোকটা জিজ্ঞেস করল একজন বুড়ো মানুষের কাছ থেকে আমরা একটা রুপোবাঁধানো বাঁশি কিনেছি কি না। যদি কিনে থাকি তবে তারা বাঁশিটা ডবল দামে কিনে নেবে। শুনে আমার ভারী মনখারাপ হয়ে গেল। বাঁশিটা তোমাকে কিনতে দিলেই ভাল করতুম। ডবল দাম পাওয়া যেত।”
বটেশ্বরের বুকের ভিতরটা খুব ধুকুর পুকুর করছিল। বলল, “তা তুমি কী বললে?”
“বললুম, একজন বুড়োমানুষ বাঁশি বেচতে এসেছিল বটে, দরদামও হয়েছিল, কিন্তু শেষ অবধি আমরা নিইনি। তখন জিজ্ঞেস করল, বাঁশিটা কে কিনেছে তা আমি জানি কি না। আমি বললাম, অত দাম দিয়ে ও বাঁশি এখানে কে কিনবে। তবে আমি ঠিক জানি না। দেখলাম বাঁশির জন্য খুব গরজ।”
“এলেবেলে লোক, নাকি পয়সাওয়ালা?”
“না, না, বেশ পয়সাওলা লোক বলেই মনে হল। শকুনির মতো দেখতে লোকটার হাতে কয়েকটা আংটি ছিল, গলায় সোনার চেন, গায়ে সিল্কের পাঞ্জাবি আর পরনে ধাক্কাপেড়ে ধুতি। লোকটার বেশ চোমড়ানো গোঁফ আর বাবরি চুল। তবে চোখ দুটো যেন বাঘের মতো জ্বলজ্বলে, তাকালে ভয়-ভয় করে।”
“আর সঙ্গের লোকটা?”
“সে কথাবার্তা বলেনি, চুপচাপ দাঁড়িয়ে ছিল। তাকে দেখে পালোয়ান টালোয়ান মনে হয়। পাহাড়ের মতো শরীর। এখন মনে হচ্ছে বাঁশিটা তোমাকে কিনতে না দিয়ে ভুলই হয়েছে।”
বটেশ্বর একথার জবাব দিল না। চিন্তিত মুখে সে কুয়োপাড়ে হাত মুখ ধুতে গেল। বাঁশিটার কী এমন মহিমা যে, লোকে ডবল দামে কিনতে চায়! ঘটনাটা বেশ চিন্তায় ফেলে দিল তাকে। তবে এটা বোঝ শক্ত নয় যে, বাঁশিটা খুব সাধারণ বাঁশি হলে লোকে বাড়ি বয়ে খবর করতে আসত না। সুতরাং বটেশ্বরের বুকের ধুকধুকুনিটা কমল না। একটা অজানা আশঙ্কায় তার মনটা কু ডাকতে লাগল।
ময়নাগড়ে নানান মানুষের নানান সমস্যা। যেমন কালীপদ সমাদ্দার। সে হল চিরকেলে ব্যথা-বেদনার রুগি। ব্যথা ছাড়া জীবনে একটা দিনও কাটায়নি সে। একদিন দাঁতব্যথায় কাতরায় তো পরদিন কান কটকটানির চোটে বাপ রে মা রে করে চেঁচায়। পরদিনই হয়তো কানের বদলে হাঁটু কামড়ে ধরে একটা কেঁদো বাঘ যেন হাড়মাস চিবোতে থাকে। দু’দিন পর মাজায় যেন কুড়ুলের কোপ পড়ার মতো ঝলকে ঝলকে ব্যথা শানিয়ে ওঠে। কোমর সারল তো মাথায় যেন কেউটের ছোবলের মতো ব্যথার বিষ তাকে কাহিল করে ফেলে। যেদিন আর কোনও ব্যথা না থাকে সেদিন পেটের মধ্যে পুরনো আমাশার ব্যথাটা চাগিয়ে উঠে তাকে পাগল করে তোলে। ব্রজ কবরেজ অনেক নিরখ পরখ করে বলেছে, আসলে ব্যথা তোমার একটাই, তবে সেটা বানরের মতো এ ডালে ও ডালে লাফিয়ে বেড়ায়। ও ব্যথা যেমন চালাক তেমনি বজ্জাত। হাঁটুর ব্যথার ওষুধ দিলে ও গিয়ে মাজায় ঘাপটি মেরে থাকে। মাজায় ওষুধ পড়লেই লম্ফ দিয়ে দাঁতের গোড়ায় গিয়ে লুকিয়ে থাকে। সেখান থেকে তাড়া খেলে গিয়ে কানের মধ্যে সেঁধোয়। ওর নাগাল পাওয়াই ভার, তাই বাগে আনাও শক্ত।”
ব্যথার ইতিবৃত্ত শুনে হোমিওপ্যাথ নগেন পাল চিন্তিত মুখে বলেছিল, ব্যথা তো আমি এক ডোজেই কমিয়ে দিতে পারি। কিন্তু ওই মাজার ব্যথা তারপর কী মূর্তি ধারণ করবে সেইটেই ভাবনার কথা। নিত্যকালীপিসির পিঠের ব্যথা কমাতে গিয়ে কী হয়েছিল জানো? পিঠের ব্যথা সারতেই তার মাথার গণ্ডগোল দেখা দিল। চেঁচায়, কাঁদে, বিড়বিড় করে। দিলাম মাথার ওষুধ, মাথা ভাল হয়ে গিয়ে পিঠের ব্যথা ফিরে এল। তাই আমি বলি কী, ওই মাজার ব্যথাকে না ঘাঁটানোই ভাল। কাবলিওয়ালাকে তাড়ালে হয়তো কাঁপালিক এসে থানা গেড়ে বসবে। তাতে লাভ কী?