বিষ্ণুরামদারোগা উঠে বজ্রকণ্ঠে বলল, “এই যে আজ সমাজবিরোধীর ঘুসিতে বটেশ্বরের নাক কেটে রক্ত পড়েছে, বীরের এই রক্তস্রোত, মাতার এই অশ্রুধারা, এর যত মূল্য সে কি ধরার ধুলায় হবে হারা? আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো একুশে ফেব্রুয়ারি, আমি কি ভুলিতে পারি? ভুলি নাই, ভুলি নাই, ভুলি নাই প্রিয়া। প্রার্থনা করো যারা কেড়ে খায় তেত্রিশ কোটির মুখের গ্রাস, লেখা হয় যেন আমার রক্তলেখায় তাদের সাশ। ভাইসব, অন্যায় যে করে আর অন্যায় যে সহে, তব ঘৃণা যেন তারে তৃণসম দহে। যাহারা তোমার বিষাইছে বায়ু, নিভাইছে তব আলো, তুমি কি তাদের ক্ষমা করিয়াছ, তুমি কি বেসেছ ভাল? বলুন আপনারা, এই দেশের জন্যই কি শহিদ ক্ষুদিরাম, শহিদ ভগৎ সিং, শহিদ গোষ্ঠ পাল প্রাণ দিয়ে গেছেন?”
কানের ব্যথা নিয়ে সভায় এসেছিল কালীপদ। খানিক বাদে নড়েচড়ে বসে পাশে বসা হাঁদু মল্লিককে বলল, “বুঝলে দুদা, কানের কটকটানিটা সেরে গিয়ে এখন বেশ ঝরঝরে লাগছে। বিষ্ণুরামদারোগা কেমন সত্যগোপালকে টেক্কা মেরে বেরিয়ে গেল দেখলে?”
হাঁদু মুখ শুকনো করে বলে, “সে না হয় হল। কিন্তু গঞ্জে সমাজবিরোধীরা আনাগোনা করছে, এ তো ভাল কথা নয় রে ভাই। দুটো পয়সা নাড়াচাড়া করতে হয়, পয়সা ছাড়া গরিবের আর আছেটাই বা কী বলল! তাতেও তো দেখছি শনি এসে ঢুকল। এরকম হলে কাজ কারবার তুলে দিয়ে যে আমাকে কাশীবাসী হতে হবে।”
পিছন থেকে রাখাল বলল, “আহা, কাশীটাই বা কী এমন সুখের জায়গা বলল। এই তো হরেন ব্ৰহ্ম কাশীতে তীর্থ করতে গিয়ে বাটপাড়ের হাতে সর্বস্ব খুইয়ে এসেছে। তবু যদি যেতে হয় এক বস্ত্রে যেও। তোমার কারবার আমিই দেখেশুনে রাখব ’খন।”
বিশু একটা তাচ্ছিল্যের মুখভঙ্গি করে বলল, “ছোঃ, যে ছত্রিশের কত নামে আর কত হাতে থাকে তাই জানে না সে আবার কারবারি!”
আর একটু হলেই হদুর সঙ্গে বিশুর হাতাহাতি লেগে যাচ্ছিল, এমন সময় হেডস্যার পান্নালালবাবু উঠে দাঁড়িয়ে বেঁটে তলোয়ারের মতো ঝকঝকে ল্যাজাটা তুলে ধরে জনসাধারণকে দেখিয়ে বললেন, “ভাইসব, এই সেই ল্যাজা। এই ল্যাজা দিয়েই দুষ্কৃতী বটেশ্বরের মুড়ো কাটতে চেয়েছিল। ল্যাজা দিয়ে মুড়ো কাটার এই অপচেষ্টা গাজিসাহেবের বীরত্বে ব্যর্থ হয়েছে বটে, কিন্তু লক্ষণ দেখে মনে হচ্ছে, এই অপচেষ্টা আবার হবে। ল্যাজা দিয়ে মুড়ো কাটার এই অপসংস্কৃতি ময়নাগড় থেকে দূর করতেই হবে, নইলে আমাদের শান্তি নেই। বন্ধুগণ, আজ হাজার কণ্ঠে আপনারা আওয়াজ তুলুন, ল্যাজা দিয়ে মুড়ো কাটা চলবে না, চলবে না …”
সঙ্গে সঙ্গে জনতা গর্জন করে উঠল, “চলবে না, চলবে না।”
এর পর উঠল ইরফান গাজি। সে বলল, “ভাইসব, আমি কথাটথা বিশেষ কইতে পারি না। বক্তৃতা দিতে জানি না। শুধু বলি, সামনে ঘোর বিপদ। সব কথা প্রকাশ্যে ভেঙে বলা যাবে না। শুধু বলি, মোহন রায়ের বাঁশি যদি বদমাশদের হাতে পড়ে থাকে তা হলে এটা ভূতপ্রেতের রাজ্য হয়ে যাবে। তাই এখনই বদমাশ দুটোকে ধরতে হবে। নইলে রক্ষে নেই।”
ভিড়ের পিছনে, একটু দুরে, অন্ধকারে দুই মূর্তি পাশাপাশি বসা।
পরাণ মৃদুস্বরে বলল, “ওস্তাদজি, গাজিসাহেব যা বলল তা কি সত্যি?”
শ্রীনিবাস মাথা নেড়ে বলে, “সেরকমই তো জানি। তবে সত্যি মিথ্যে যাচাই তো হয়নি। কেতুগড় রাজবাড়ির মহাফেজখানার পুঁথিপত্রে সেরকমই লেখা আছে।”
“মোহন রায়টা কে বলুন তো?”
“দেড়শো বছর আগে রাজা শশাঙ্কনারায়ণের সভায় বাঁশি বাজাত, গুণী মানুষ।”
“আর একটু ভেঙে বললে হয় না ওস্তাদ?”
“সব কথা একবারে শুনলে তোর মাথায় জট পাকিয়ে যাবে। অল্প অল্প করে শোনাই তো ভাল। তোর মাথায় যে গোবর সেটা কি ভুলে গেলি?”
“আপনার কাছে ক’দিন তালিম নিয়ে মাথাটা একটু খোলসা হয়েছে কিন্তু।”
“বটে! কীরকম?”
“এই ধরুন আমার কেমন যেন মনে হচ্ছে, বাঁশিটার মধ্যে মন্ত্র তন্ত্রের একটা ব্যাপার আছে। বাঁশিটা বাজলে হয়তো ঘূর্ণি ঝড় উঠবে বা নদীতে বান আসবে বা ভূমিকম্প গোছের কিছু হবে।”
“বাপ রে! তোর তো দেখছি গুরুমারা বিদ্যে!”
“ঠিক বলিনি?”
“অনেকটাই বলেছিস বাপু। আর বলতে কী, কিছু খারাপও বলিসনি।”
“তবেই বুঝুন, আমার মাথায় সবটুকুই গোবর নয়। আগে আমি নিজের মাথা থেকে একটা গোবর-গোবর গন্ধও পেতুম। আজকাল কিন্তু পাচ্ছি না।”
“বোধহয় গোবরের রস মরে ঘুঁটে হয়েছে। তবু বলি আন্দাজ করেছিস মন্দ নয়।”
“এবার তা হলে ভেঙে বলুন।”
“ভেঙে বলিই বা কী করে? মোহন রায় তো খোলসা করে সব লিখে যায়নি। সাঁটে লিখে গেছে। একে রসাভাস, দুইয়ে নিদ্রাপাশ, তিনে সর্বনাশ।”
“এ যে আরও গুবলেট হয়ে গেল ওস্তাদ। বুদ্ধিটা সবে ঘুম ভেঙে হাই তুলছে। এখনও আড় ভাঙেনি। এখনই কি আর অত শক্ত শক্ত অঙ্ক পারব?”
“অঙ্ক তো আমার নয় রে, মোহন রায়ের। তবে বাঁশিটার নীচের দিকে তিনটে ঘঁাদা আছে। তিনটেই ছিপি দিয়ে আঁট করে বন্ধ। প্রথম ছিপিটা খুলে দিলে বাঁশির সুরে চারদিকে আনন্দের লহরী বইবে। লোকে সেই সুরে মাতাল হয়ে ঝুঁদ হয়ে থাকবে। যদি প্রথম ‘ছ্যাঁদা বন্ধ রেখে দু’নম্বর ছ্যাঁদার ছিপি খোলা যায় তা হলে ওই নিদ্রাপাশ। মানে যতদুর বাঁশির শব্দ যাবে ততদূর মানুষজন পশুপাখি সব ঢলাঢল ঘুমিয়ে পড়বে। পাশ মানে জানিস?”