খেয়েদেয়ে দুপুরে খাঁটিয়ার বিছানায় একটু গড়িয়ে নিচ্ছিল ইরফান। কিন্তু কী যেন বড্ড কুটকুট করে কামড়াচ্ছে। কিছুক্ষণ ঘুমোনোর চেষ্টা করে বিরক্ত হয়ে উঠে বসে ইরফান রাগারাগি করতে লাগল, “আমার বিছানায় যে ছারপোকা হয়েছে এটা কি কারও জানা নেই নাকি!”
তার বউ এসে বলল, “তোমার বিছানায় ছারপোকা! অবাক করলে যে! ওই বিছানা আমি নিজে রোজ রোদে দিই, ঝাড়ি।”
“তবে কামড়াচ্ছে কেন?”
ইরফানের বউ বিছানাটা তন্ন তন্ন করে উলটে পালটে দেখে বলে, “কোথায় ছারপোকা! পিঁপড়েও তো নেই। এ তোমার মনের বাতিক।”
ইরফান বোকা বনে অনেকক্ষণ গুম হয়ে বসে থাকার পর হঠাৎ বুঝতে পারল, তাকে যা কামড়াচ্ছে তা ছারপোকা বা পিঁপড়ে নয়। কামড়াচ্ছে তার বিবেক। আনাড়ির হাতে বিপজ্জনক বাঁশিটা ছেড়ে দেওয়া অবিবেচকের কাজ হয়েছে।
সুতরাং ইরফান উঠে পায়জামা কুর্তা পরে হাতে একটা ঘেঁটে লাঠি নিয়ে বেরিয়ে পড়ল। ময়নাগড় তাকে আরও একটা কারণে আকর্ষণ করছিল। বটেশ্বর যে অমৃত খাইয়ে গেছে সেই রামগোপালের রসগোল্লা আরও গোটাকতক খেতে না পারলে মনটা ঠাণ্ডা হচ্ছে না।
ময়নাগড়ে পৌঁছে সে সোজা রামগোপাল ঘোষের দোকানে হাজির হয়ে হাঁক মারল, “কই হে রামগোপাল, দাও তো গোটাচারেক গরম গরম রসগোল্লা।”
রামগোপাল ইরফানকে দেখে সসম্ভ্রমে উঠে দাঁড়িয়ে হাতজোড় করে বলল, “মাপ করবেন গাজি সাহেব, ওটি পারব না। আপনার মিষ্টি খাওয়া বারণ আমি জানি, রসগোল্লা আপনার পক্ষে বিষতুল্য।”
ইরফান মিটমিট করে রামগোপালের দিকে খানিক চেয়ে থেকে একটু হেসে গলা নামিয়ে বলল, “আহা, না হয় রসটা নিংড়েই দাও না।”
“না গাজিসাহেব, তা হলে আমাকে নরকে যেতে হবে।”
ইরফান হুঙ্কার দিয়ে বলল, “আর ক্ষুধার্তকে খাদ্য না দিলে বুঝি পাপ হয় না? তখন দোজখে যেতে হবে না?”
“খাবেন না কেন, অবশ্যই খাবেন। ভাল নিমকি আছে, ঘুঘনি আছে কচুরি আছে।”
“দুর, দুর! ওসব তো ইবলিশের খাদ্য। ভদ্রলোকের খাদ্য হল মেঠাই।”
“তা হলে গরম চপ আর মুড়ি!”
“না হে, উঠি। একটা মর্কটকে খুঁজে বের করতে হবে। তাড়া আছে।”
কিন্তু তাড়া থাকলেও তাড়াতাড়ি করার উপায় ছিল না। পথে তাকে দেখে সবাই সসম্ভ্রমে নমস্কার জানায়, দু-চারটে কথাও কয়। এই করতে করতে দেরি হয়ে অন্ধকার নেমে পড়ল। বটেশ্বরের বাড়িতে গিয়ে হাজির হলে তার বউ বলল, “দেখুন তো গাজিসাহেব, লোকটার যে কী হয়েছে, সর্বদাই অন্যমনস্ক থাকে। সন্ধের পর কোথায় যে যায় কে জানে। সেদিন আমাদের গয়লা রামবচন বলল, দিঘির পাড়ে খোঁটা-ওপড়ানো গোরু খুঁজতে গিয়ে নাকি ওকে দেখেছে একটা লাঠি হাতে নিয়ে বসে আছে।”
“দিঘি! সে তো গাঁয়ের বাইরে।”
“হ্যাঁ, সাপখোপ আছে, সন্ধের পর অন্য ভয়ও আছে, কিন্তু কথা মোটে কানে তোলে না।”
চিন্তিত ইরফান তাড়াতাড়ি হাঁটা দিল। লক্ষণ ভাল ঠেকছে না। ছোঁকরা বাঁশিটা বাজানোর তাল করছে।
তাড়াতাড়ি করেও দেরি হয়ে গেল ইরফানের। আরও একটু দেরি হলে অবশ্য আর বটেশ্বরকে পাওয়া যেত না।
অন্ধকার দিঘির ধারে দূর থেকে একটা হুটপাট এবং তারপর টর্চের আলো দেখে ইরফানের হঠাৎ মনে হল, একটা বিপদ ঘটছে। কেন মনে হল কে জানে। হঠাৎ ঘেঁটে লাঠিটা বাগিয়ে সে ছুটপায়ে গিয়ে আবছা অন্ধকারেও ল্যাজার ঝিলিকটা দেখতে পেল। বাঘের মতো লাফিয়ে চিন্তা ভাবনা না করেই সে ঘেঁটে লাঠিটা লোকটার কোমরে সপাটে বসিয়ে দিল।
লোকটা ‘বাপ রে’ বলে লাফিয়ে উঠতেই আরও এক ঘা। ল্যাজাটা ছিটকে পড়ল হাত থেকে। লোকটা চোখের পলকে হাওয়া হয়ে গেল। সঙ্গে আরও একটা লোকও দৌড়ে জঙ্গলে গিয়ে ঢুকল।
ইরফান বটেশ্বরের পাশে হাঁটু গেড়ে বসে আপনমনেই বিড়বিড় করে বলতে লাগল, “আহাম্মক কোথাকার, বাঁশির জন্য প্রাণটাই যে যাচ্ছিল তোর!”
দিঘি থেকে এক আঁজলা জল তুলে এনে মুখে ঝটকা দিতেই উঠে বসল বটেশ্বর। তারপর ডুকরে উঠে বলল, “গাজিসাহেব, বাঁশিটা যে নিয়ে গেল।”
“তোকে বলেছিলুম কি না, জায়গার জিনিস জায়গায় রেখে আয়!”
“কিন্তু এখন কী হবে?”
“সর্বনাশ করে বসে আছিস। শয়তানদের হাতে পড়লে এ-জায়গা শ্মশান করে ছেড়ে দেবে। এখন ওঠ বাপু, ঘরে যা, প্রাণে যে বেঁচে আছিস সেই ঢের। আমারও কাজ বাড়ালি।”
“আপনি বুড়ো মানুষ, কী করবেন?”
ইরফান খিঁচিয়ে উঠে বলে, “বুড়ো মানুষের লাঠির জোর ছিল বলেই তো বেঁচে গেলি।”
কাপড়ের খুঁটে নাকটা চেপে ধরে বটেশ্বর বলল, “তা ঠিক। তবে কিনা বারবার কি ওরকম হবে? তার চেয়ে গাঁয়ের লোকদের জানাই চলুন।”
“অতি সন্নিসিতে যে গাজন নষ্ট।”
“না গাজিসাহেব, আপনি একলা অত সাহস করবেন না। যে লোকটা আমাকে মেরেছে তার বিশাল চেহারা, গায়ে পেল্লায় জোর।”
ইরফান একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল, “তাই করি চল। গাঁয়ের লোকদেরই জানাই।”
ঘণ্টাখানেক বাদে হাটখোলার মাঠে মেলা লোক জড়ো হয়েছে। দশ-বারোটা হ্যাজাক জ্বলছে। মাইকে দাঁড়িয়ে সত্যগোপাল কম্বুকণ্ঠে ভাষণ দিচ্ছিল, “ভাইসব, ময়নাগড় আর সেই ময়নাগড় নেই। এই ময়নাগড়কে নিয়েই কবি গান বেঁধেছিলেন, এমন দেশটি কোথাও খুঁজে পাবে না কো তুমি, সকল দেশের রানী সে যে আমার জন্মভূমি। এখানে গাছে গাছে মলয় পবনের মর্মরধ্বনি, নদীর কুলু কুলু তান, কোকিলের কুহু কুহু গান শোনা যেত। খেতে ধান, গোয়ালে গোরু, মুখে হাসি, এই ছিল ময়নাগড়ের চিরপরিচিত দৃশ্য। আজ সেই সোনার ময়নাগড় সমাজবিরোধীদের দৌরাত্ম্যে ছারখার হয়ে যাচ্ছে।” ইত্যাদি ইত্যাদি।