ময়নাগড়ের বিখ্যাত ময়রা রামগোপাল ঘোষের এক হাঁড়ি রসগোল্লা নিয়ে গিয়েছিল বটেশ্বর। বাঁশিটা পিছনে মালকোচার সঙ্গে খুঁজে নিয়েছিল। গিয়ে বাইরে থেকে “গাজিসাহেব! গাজিসাহেব!” বলে ডাকাডাকি করতেই ইরফান বেরিয়ে এল। সাদাদাড়িতে মেহেন্দির রং, পরনে সাদা লুঙ্গি, গায়ে গেঞ্জি। চেহারাটা রোগা হলেও পোক্ত, চোখে শ্যেন দৃষ্টি। হেঁড়ে গলায় বলল, “কী চাই?”
“আজ্ঞে, এই একটু রসগোল্লা এনেছিলুম।”
ইরফানের রোখা ভাবটা একটু নরম হল, তবু তেজের গলায় বলল, “কে তুই? কী মতলব?”
“আজ্ঞে, আপনি গুণী মানুষ, তাই–”
“আমার গুণের তুই কী বুঝিস?”
তটস্থ বটেশ্বর বলে, “আমরা মুখ মানুষ, কী বুঝব! লোকে বলে, তাই শুনেই জানি।”
“আমার যে রসগোল্লা খাওয়া বারণ তা জানিস না?”
একগাল হেসে বটেশ্বর বলল, “রসগোল্লা খাওয়া বারণ হবে কেন? আপনার তো মিষ্টি খাওয়া বারণ! তাই তো আমি রামগোপাল ঘোষের বিখ্যাত নোতা রসগোল্লা অর্ডার দিয়ে বানিয়ে এনেছি। এতে মিষ্টির ম-টাও পাবেন না।”
ইরফান ঘোড়েল লোক। ব্যাপারটা বুঝে নিয়ে গলা তুলে বাড়ির লোক যাতে শুনতে পায় এমনভাবে বলল, “ও তাই বল। রামগোপালের সেই বিখ্যাত নমকিন রসগোল্লা তো! তা নিয়ে আয় তো, দেখি কেমন বানায়। খুব নাম শুনেছি বটে, এখনও চেখে দেখা হয়নি।”
চালাকিটা অবশ্য খাটল না। বাড়ির লোকেরা মোনতা রসগোল্লায় তেমন বিশ্বাসী নয়। তাই রসগোল্লার হাঁড়ি কেড়ে নিয়ে গেল।
ততক্ষণে অবশ্য ইরফান গোটাতিনেক টপাটপ মেরে দিয়ে বলছিল, “বাঃ বাঃ, নুন দিয়ে জারিয়েছে তো ভাল!”
রসগোল্লা নিয়ে বাড়িতে যে চেঁচামিচিটা হল সেটা একটু স্থিমিত হতেই বাঁশিটা বের করে ইরফানকে দেখাল বটেশ্বর, “ওস্তাদ, এ বাঁশিটায় শব্দ বের হয় না কেন বলবেন? বাঁশিটা কি খারাপ?”
ইরফান ঘুরিয়ে ফিরিয়ে অনেকক্ষণ ধরে বাঁশিটা দেখে বলল, “এটা কোথায় পেয়েছিস?”
“আজ্ঞে, একটা লোক একশো টাকায় বেচে দিয়ে গেছে।”
ভ্রু কুঁচকে ইরফান বলল, “মোটে একশো? এর দাম তো লাখ টাকারও বেশি।”
“বলেন কী!” ইরফান একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বাঁশিটা তাকে ফিরিয়ে দিয়ে বলল, “একে রসাভাস, দুইয়ে নিদ্রাপাশ, তিনে সর্বনাশ।”
“তার মানে?”
“যদি ভাল চাস তো ও বাঁশি কখনও বাজাসনে। ও হল মোহন রায়ের বাঁশি। কেতুগড় রাজবাড়ির জিনিস।”
“আপনি কি মোহন রায়কে চিনতেন?”
“তুই কি বুরবক? মোহন রায়ের এন্তেকাল হয়েছে একশো বছরেরও আগে।”
“এ বাঁশিতে তাহলে রহস্যটা কী?”
“তা আমি জানি না। এখন বিদেয় হ। আর মনে রাখিস ও বাঁশি বাজাতে নেই। যার কর্ম তারে সাজে, অন্যের হাতে লাঠি বাজে। যা, যা, বাঁশিটা বাঁশির জায়গামতো রেখে আয়।”
“আজ্ঞে ওস্তাদ, আপনি যদি একবার বাঁশিটা একটু বাজিয়ে শোনাতেন তা হলে ধন্য হতাম। শুনেছি বাঁশিটায় নাকি ভর হয়।”
ইরফান হাতের কাছে আর কিছু না পেয়ে একটা সুপুরি কাটার ভারী জাতি নিয়ে তাকে তাড়া করেছিল।
গাজিসাহেবের কথার মাথামুণ্ডু কিছুই বুঝতে পারেনি বটেশ্বর। শুধু এটুকু বুঝেছে যে, বাঁশিটা এলেবেলে বাঁশি নয়। কিন্তু লাখ টাকা দামের এই বাঁশির মহিমা কী। সেটাও বোঝা দরকার। বটেশ্বর ভারী বিভ্রান্ত বোধ করছে। আর ওই তিনটে কথারই বা মানে কী? একে রসাভাস, দুইয়ে নিদ্রাপাশ, তিনে সর্বনাশ!
অন্ধকারে কাছেপিঠে কোথাও একটা মৃদু গলা খাঁকারির শব্দ হল। সচকিত হয়ে বটেশ্বর বাঁশিটা তার জামার তলায় লুকিয়ে ফেলল। এ সময়ে এদিকপানে কারও আসার কথা নয়। তাই একটু উৎকর্ণ হল বটেশ্বর। অন্ধকারটা তার চোখ-সওয়া হয়ে গেছে। আবছামতো সবই দেখতে পাচ্ছে সে। ঝোঁপঝাড়ের আড়ালে কেউ ঘাপটি মেরে নজর রাখছে না তো!
বটেশ্বর টপ করে উঠে পড়ল। গাজিসাহেব বলেছিল বাঁশিটার দাম লাখ টাকা। হতেও পারে বা। সে চারদিকে নজর রাখতে রাখতে ঘাট ছেড়ে নির্জন পথ ধরে গায়ের দিকে রওনা হল।
কিন্তু কয়েক কদম যেতে না যেতেই তার মনে হল কে বা কারা তার পিছু নিয়েছে। মনটায় বড় অস্বস্তি হচ্ছে তার। জায়গাটায় এত গাছগাছালি আর ঝোঁপঝাড় যে, কেউ লুকিয়ে পিছু নিলেও নজরে পড়া কঠিন। বটেশ্বর ঊর্ধ্বশ্বাসে হাঁটতে লাগল।
কিন্তু বেশিদূর যেতে পারল না। আচমকাই একটা মস্ত লম্বা আর পেল্লায় চেহারার লোক অন্ধকার কুঁড়ে বেরিয়ে এসে তার পথ আটকে দাঁড়াল।
বটেশ্বর চেঁচাবে বলে সবে হাঁ করেছিল, কিন্তু গলায় স্বর ফোঁটার আগেই গদাম করে মুগুরের মতো একটা ঘুষি এসে তার মুখে পড়ল, আর সে চোখে অন্ধকার আর আলোর ফুলকি দেখতে দেখতে অজ্ঞান হয়ে পড়ে গেল মাটিতে।
পিছন থেকে লম্বাপানা ধুতি পাঞ্জাবি পরা আরও একটা লোক এগিয়ে এসে বটেশ্বরের মুখে জোরালো একটা টর্চের আলো ফেলে বিশাল চেহারার লোকটাকে জিজ্ঞেস করল, “তোকে দেখেছে?”
“দেখেছে।”
“তবে সাক্ষী রাখার দরকার নেই। গলার নলিটা কেটে দে।”
লোকটা নিচু হয়ে বটেশ্বরের শিথিল হাত থেকে গড়িয়ে পড়া বাঁশিটা তুলে নিয়ে রোগা লোকটার হাতে দিল। তারপর কোমর থেকে একটা ঝকঝকে ল্যাজা বের করে বটেশ্বরের গলা লক্ষ্য করে তুলল।
.
এখন হয়েছে কী, বটেশ্বরকে বিদেয় করার পর থেকে ইরফান গাজির মনটা খুঁতখুঁত করছিল। একটা আনাড়ির হাতে বাঁশিটা ছেড়ে দেওয়া কি উচিত কাজ হল। যদিও ওই বাঁশি বাজানো প্রায় অসম্ভব ব্যাপার তবু কিছু বলাও যায় না। মোহন রায়ের ওই মোহন বাঁশি যে কার ফুয়ে বেজে উঠবে তা কে জানে!