নরেন্দ্রনারায়ণ স্মিতহাস্য করে বলল, “আচ্ছা না হয় পঞ্চাশ ভরিই হল, তাতেই বা কী যায় আসে বলুন!”
বিষ্ণুরাম অগ্নিশর্মা হয়ে বলে, “সন্দেহ করছ বুঝি! ভেবেছ, কালোবরণ স্যাঁকরা মিথ্যে কথা বলে গেছে? দারোগার বাড়িতে এসে মিছে কথা কইবে, তার ঘাড়ে কটা মাথা? কথার প্যাঁচে ফেলে রেকাবির ওজন জেনে যাবে সেটি হবে না। বুঝলে!”
“আজ্ঞে, বুঝলাম।”
“কী বুঝলে?”
“বুঝলাম যে, আপনার গিন্নি মোটেই পঞ্চাশ ভরির তিনটে সোনার রেকাবি আর দুটো হিরের আংটি মোট আড়াইশো টাকায় কেনেননি। তিনি তখন বাপের বাড়িতে ছিলেন, আর কালোবরণ স্যাঁকরা মোটেই রেকাবির ওজন কমিয়ে বা বাড়িয়ে বলেনি। ঠিক তো?”
বিষ্ণুরাম রিভলভারটা ফের খাপে ভরে বলল, “হ্যাঁ। কথাটা মনে থাকে যেন! আমি ভাল থাকলে গঙ্গাজল, রাগলে মুচির কুকুর, বুঝেছ?”
“সে আর বুঝিনি! খুব বুঝেছি। তবে কী জানেন দারোগাবাবু, কেতুগড়ের রাজবাড়ি থেকে জিনিসগুলো যে সরিয়েছে সে সাধারণ চোর নয়। কোনও সিন্দুক বা লোহার আলমারিই তার কাছে কিছু নয়। তাই বলছিলাম, একটু সাবধান থাকবেন।”
“তার মানে?”
“আমাদের কাছে খবর আছে এদিক পানেই এসেছে চোর মশাই। অমন চোর লাখে একটা জন্মায়। আপনাকে একটু সাবধান করতেই আসা। আচ্ছা চলি। নমস্কার।”
লোকদুটো বিদেয় হওয়ার পর বিষ্ণুরাম ধপাস করে চেয়ারে বসে পড়ে ফের রুমালে কপালের ঘাম মুছে বলে, “জোর বাঁচা গেছে। দেখলি তো নবু, লোকটাকে কেমন বোকা বানিয়ে ছাড়লাম। এসেছিল পেটের কথা টেনে বের করতে। কেমন ঘোলটা খাওয়ালাম বল।”
নবু বড় বড় দাঁত বের করে খুব হেসেটেসে বিগলিত হয়ে বলল, “তা আর দেখিনি! চোখের সামনে যেন আলিবাবা নাটক দেখছিলাম। একেবারে চিচিং ফাঁক। রেকাবি, আংটি আর আপনার আক্কেল সব যেন দাঁত কেলিয়ে বেরিয়ে পড়ল।“
বিষ্ণুরাম একগাল হেসে বলে, “তবেই বল।”
নবু মাথা নেড়ে বলল, “ওঃ, বুদ্ধিও বটে আপনার। যা কস্মিনকালেও বলার নয় তাও কেমন গড়গড় করে বলে দিলেন। থলি থেকে যেন ম্যাও বেরোল। লোকে কি আর সাধে আপনাকে অকাল কুম্মাণ্ড বলে!”
বিষ্ণুরাম গর্জন করে উঠে বলে, “কার এত সাহস! কার এত বুকের পাটা?”
ভারী বিনয়ের সঙ্গে নবু বলল, “আদর করেই বলে, ভালবেসেই বলে। কুমড়ো কি আর খারাপ জিনিস বড়বাবু? ঘাট বলুন, চচ্চড়ি বলুন, ছোলা দিয়ে ছক্কা বলুন, পোড়ের ভাজা বলুন-কোনটা কুমড়ো ছাড়া চলে? এক ফোঁটা সর্ষের তেল আর কাঁচা লঙ্কা দিয়ে কুমড়ো সেদ্ধ খেয়ে দেখুন, অমৃত। ঘরে ঘরে কুমড়োর আদর।”
বিষ্ণুরাম স্তিমিত হয়ে বলল, “সত্যি বলছিস যে, আদর করে বলে।”
“আদর মানে! তারা তো আদরের চাঁদরে মুড়ে রেখেছে। আপনাকে। আদর করে তারা যে আপনাকে গোবর গণেশ, সাক্ষীগোপাল, অকালঘেঁড়েও বলে সে তো আর এমনি এমনি নয়। গুণের কদর করে বলেই বলে।”
“তুই কি বলতে চাস ওগুলোও ভাল ভাল কথা?”
“তা নয় তো কী! গোবর অতি পবিত্র জিনিস, সকাল বিকেল গোবর ছড়া না দিলে ঘরদোর শুদ্ধ হয় না। না হয় বাড়ির গিন্নিমাকে জিজ্ঞেস করে দেখবেন আর গণেশবাবার কথা কী আর বলব, সিদ্ধিদাতা স্বয়ং। তারপর ধরুন সাক্ষীগোপাল। কত বড় জাগ্রত দেবতা বলুন, এক জায়গায় বসে বসে গোটা দুনিয়ার লাগাম কষছেন। আর অকালঘেঁড়ে? তাও ধরতে গেলে একটা ভাল কথাই। মানেটা আমার জানা নেই বটে, কিন্তু লোকে যখন আদর করে বলছে তখন খারাপ কিছু হবে না।”
“তুই যখন বলছিস তখন না হয় মেনে নিচ্ছি। কিন্তু কথাগুলোকে আমার ঠিক পছন্দ হচ্ছে না।”
.
গত সাত দিন ধরে বাঁশিটা নিয়ে ধস্তাধস্তি করছে বটেশ্বর। কিন্তু ব্যাদড়া বাঁশি আজ অবধি একটা পোঁ শব্দ অবধি ছাড়েনি। বটেশ্বর যতবার ফুঁ দেয় ততবারই খানিক বাতাস দীর্ঘশ্বাসের শব্দ তুলে বেরিয়ে যায়। ভাগ্যিস রাতের দিকটায় দিঘির পাড়ে লোকজন থাকে না, তাই রক্ষে। নইলে তাকে নিয়ে হাসাহাসি হত।
আজও বাঁশি নিয়ে এসে ঘাটের পৈঠায় অন্ধকারে বসে আছে বটেশ্বর। চারদিকে অন্ধকার, তার মনে অন্ধকার, বাঁশিতে অন্ধকার। থোকা থোকা জোনাকি পোকা যেন অন্ধকারকে আরও নিরেট করে তুলেছে। ঘণ্টা খানেক বাঁশিতে আওয়াজ তোলার চেষ্টা করে এখন দমসম হয়ে পড়েছে সে।
পরশুদিন সে বাঁশি নিয়ে দুপুরবেলায় গোবিন্দপুরে ইরফান গাজির কাছে চুপিচুপি গিয়ে হাজির হয়েছিল। এই তল্লাটে ইরফানের মতো ওস্তাদ বাঁশুরিয়া আর নেই। তবে বুড়ো ভয়ংকর খিটখিটে আর বদমেজাজি। কেউ নাড়া বাঁধতে গেলে হাতের কাছে বদনা, গাডু, লাঠি যা পায় তাই নিয়ে তাড়া করে আর চেঁচায়, “বেরো! বেরো সুমুখ থেকে! দূর হয়ে যা বেসুরোর দল! পেটে সুরের স নেই, আম্বা আছে!” ভয়ের চোটে সাহস করে কেউ তার কাছে বড় একটা ঘেঁষে না। তবু প্রাণ হাতে করে বটেশ্বর গিয়েছিল। এই বাঁশিটা তাকে এমন হিপনোটাইজ করেছে যে, এখন সে সব কষ্ট স্বীকার করতে রাজি।
ইরফান গাজির চাকর বদরুদ্দিন আসলে চাকর নয়। সে বড়লোকের ছেলে। ইরফানের কাছে বাঁশি শিখবে বলে চাকর সেজে কাজে ঢুকেছে। ভোরবেলা যখন ইরফান রেওয়াজ করে তখন সে আড়াল থেকে যা পারে শিখে নেয়।
বদরুদ্দিনের কাছেই বটেশ্বর শুনেছে, ইরফানের মিষ্টি খাওয়া বারণ। ডাক্তার বলেছে, ইরফানের পক্ষে মিষ্টি বিষতুল্য। কিন্তু ওই মিষ্টিতেই ইরফান কাত। রসগোল্লা দেখলে তার কাণ্ডজ্ঞান থাকে না। বাড়ির লোকের সঙ্গে তার এই নিয়ে রোজ কাজিয়া হয়। অবশেষে বড় নাতনির শাসনে এখন ইরফান মিষ্টি খাওয়া ছেড়েছে। তবে নাতনির চোখের আড়ালে আবডালে লুকিয়েছাপিয়ে এক-আধটা খেয়ে ফেলে। বদরুদ্দিন বটেশ্বরকে বলল, “তুই দুপুরের দিকে যাস, ওই সময়ে মেহেরুন্নেসা ইস্কুলে থাকে।”