“বলিস কী?”
“আজ্ঞে, তাই তো বলছিলাম, যে লোকদুটো চোরাই জিনিসের সন্ধানে এসেছে তারা যদি গন্ধ পায় তা হলে–”
বিষ্ণুরাম তার মোটা শরীর নিয়েও তড়াক করে লাফিয়ে উঠে পিস্তলটা খাপ থেকে বের করে বিকট গলায় চেঁচিয়ে উঠল, “এক্ষুনি লোক দুটোকে ধরে এনে ফাটকে পোরা দরকার, এক্ষুনি! ওরে কে কোথায় আছিস–”
নবু বিচলিত না হয়ে ঠাণ্ডা গলায় ভারী বিনয়ের সঙ্গে বলল, “হুটপাট করার দরকার নেই বড়বাবু। রেকাবি তিনটে আর আংটি দুটো মা ঠাকরোন খুব যত্ন করে লুকিয়ে রেখেছেন, কাকপক্ষীতেও জানে না।”
উত্তেজিত বিষ্ণুরাম বলল, “তা হলে তুই জানলি কী করে?”
নবু একগাল হেসে বলল, “আজ্ঞে, আমি যে ইনফরমার, না জানলে কি আমার পেট চলবে?”
বিষ্ণুরাম ধপ করে ফের চেয়ারে বসে পড়ল। বড় বড় শ্বাস ফেলে বলল, “সোনার রেকাবি? ঠিক জানিস?”
“গিন্নিমা যে কালোবরণ স্যাঁকরাকে দিয়ে যাচাই করেছেন।”
“তার মানে কালোবরণও জানে! না না, এত জানাজানি তো ভাল কথা নয়।”
“আজ্ঞে, সোনা যাচাই করতে হলে স্যাঁকরা ছাড়া উপায় নেই কিনা।”
উত্তেজিত হয়ে বিষ্ণুরাম বলল, “গিন্নির আক্কেল দেখে বলিহারি যাই! একবার আমাকে বলবে তো! ঘরে অত সোনা, ভালরকম পাহারা বসানো দরকার।”
বিগলিত হয়ে নবু বলে, “আপনার বুদ্ধি-বিবেচনার ওপর আমাদের যেমন অগাধ আস্থা, গিন্নিমার বোধহয় ততটা নেই। না থেকে একরকম ভালই হয়েছে। বাড়িতে সেপাইসান্ত্রি বসালে পাঁচজনের সন্দেহ হতে পারে।”
বিষ্ণুরাম ভ্রুকুটিকুটিল চোখে নবর দিকে চেয়ে বলল, “কথাটা পাঁচকান করার দরকার নেই।”
“কোন কথাটা আজ্ঞে?”
“ওই যে, আমার ওপর যে গিন্নির আস্থা নেই। ওসব কথা চাউর হলে লোকে কি আর আমাকে ভক্তিশ্রদ্ধা করবে?”
“কী যে বলেন বড়বাবু, কথাটা তো আমি ভুলেই গেছি।”
“লোক দুটো এখন কোথায়?”
একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে নবুবলল, “তাদের বড় দুঃসাহস বড়বাবু।” বিষ্ণুরাম চোখ পাকিয়ে বলে, “দুঃসাহস! কেন, আমি কি মরে গেছি নাকি রে!”
মুগ্ধ চোখে দারোগা বিষ্ণুরামের দিকে চেয়ে নবু গদ গদ হয়ে বলে, “সেই পোজ, সেই পশ্চার, সেই গলা! আহা, গায়ে কাঁটা দিচ্ছে!”
“কে? কার কথা কইছিস!”
“আজ্ঞে, টিপু সুলতানের কথাই বলছি। গেলবার শীতলা মন্দিরের পাশের মাঠটায় টিপু সুলতান পালা নেমেছিল। জয় হনুমান অপেরা। নটসিংহ মহেন্দ্র বরাট টিপুসুলতানের ভূমিকায়। কী তেজ, কী গলা, কী দাপট। সেই দেখেছিলাম, আর এই আজ দেখছি। কোথায় লাগে মহেন্দ্র বরাট!”
উত্তেজিত হয়ে বিষ্ণুরাম বলে, “তারা এসে পড়লে কি আর সোনাদানা কিছু ঘরে থাকবে রে! সব যে চেঁছেচুছে নিয়ে যাবে?”
“কোন আইনে?”
“আইন! আইনের কথা উঠছে কেন?”
নবু বিজ্ঞের মতো একটু হেসে বলল, “দেশে কি আইন নেই বড়বাবু? আইনের মাথায় নৈবেদ্যের ওপর কাঠালি কলার মতো আপনিও তো আছেন! তারা এসে হাত পেতে দাঁড়ালেই তো হবে না। রেকাবি আর আংটি যে গিন্নিমার হেফাজতে আছে এটা কারও জানার কথা নয়। আর থাকলেই বা কী? ওটা গিন্নিমার পৈতৃক সম্পত্তি যে নয় তার প্রমাণ কী? মালটা যে চুরি গিয়েছিল তারই বা সাক্ষী কোথায়? আপনি গ্যাঁট হয়ে বসে থাকুন তো।”
নবু কথা শেষ করার আগেই নরেন্দ্রনারায়ণ ঘরে ঢুকল, পিছনে সেই বিশাল চেহারার লোকটা।
নরেন্দ্রনারায়ণকে দেখেই বিষ্ণুরাম হঠাৎ ফের দাঁড়িয়ে বিকট গলায় চেঁচাতে লাগল। “কে তোরা! অ্যাঁ! কে তোরা! থানায় ঢুকেছিস যে বড়, সাহস তো কম নয়! অ্যাঁ! কী চাই? কী চাই? কী মতলব? অ্যাঁ?”
বিষ্ণুরামের চেঁচামেচিতে থতমত খেয়ে দাঁড়িয়ে পড়েছিল নরেন্দ্রনারায়ণ। একটু অবাক হয়ে বলল, “আজ্ঞে, আমরা একটু খোঁজখবর করতে এসেছি।”
বিষ্ণুরাম রিভলভার উঁচিয়ে বিকট গলায় বলে, “কীসের খোঁজ খবর, অ্যাঁ! কীসের খোঁজখবর? সোনার রেকাবি চাই? নাকি হিরের আংটি চাই? অ্যাঁ! মামাবাড়ির আবদার! ওসব এখানে নেই, বুঝলে! নেই! এখন বিদেয় হও তো দেখি! নইলে গুলি করে খুলি উড়িয়ে দেব, এই বলে রাখলাম!”
নরেন্দ্রনারায়ণ আর তার সঙ্গী একটু মুখ-তাকাতাকি করে নিল। তারপর নরেন্দ্রনারায়ণ মুচকি একটু হেসে বলল, “আচ্ছা, আচ্ছা, ঠিক আছে। এখানে নেই তো কী হয়েছে? অন্য কোথাও আছে হয়তো।”
বিষ্ণুরামের চোখ বড় বড় হয়ে গেল। মুখ লালবর্ণ ধারণ করল, সে গর্জন করতে গিয়ে দেখল গলা ফেঁসে ফ্যাঁস ফ্যাঁসে আওয়াজ বেরোচ্ছে। সে সেই গলাতেই বলল, “ভেবেছ আমার গিন্নির কাছে আছে? অ্যাঁ! আমার গিন্নির কাছে আছে? খবর্দার ওসব ভুলেও মনে এনো না। তা হলে কিন্তু খারাপ হয়ে যাবে। আমার গিন্নি মোটেই তিনটে সোনার রেকাবি দেড়শো টাকা দিয়ে কেনেনি, মোটেই একশো টাকা দিয়ে এক জোড়া হিরের আংটি কেনেনি। কী রে নবু, কিনেছে? বল না হেঁকে।”
নবু হাত কচলে বলল, “কী যে বলেন! গিন্নিমা কোত্থেকে কিনবেন? উনি তো তখন বাপের বাড়িতে।”
বিষ্ণুরাম রিভলভার আপসাতে আপসাতে বলল, “শুনলে তো! ওসব জিনিস এখানে নেই। এবার তোমরা বিদেয় হও। ফের কোনওদিন থানার ত্রিসীমানায় দেখলে গুলি চালিয়ে দেব। বুঝলে?”
নরেন্দ্রনারায়ণ ঘাড় কাত করে বলল, “আজ্ঞে, বুঝেছি। কিন্তু জিনিসগুলো গেল কোথায় বলুন তো দারোগাবাবু! তিন তিনটে সোনার রেকাবি-র ওজন–”
বিষ্ণুরাম তাচ্ছিল্যের হাসি হেসে বলল, “পঞ্চাশ ভরি, বলবে তো! ওসব চালাকি আমি জানি। হুঁ হুঁ বাবা, ঘুঘু দেখেছ, ফাঁদ দ্যাখোনি। যতই চালাকি করে পেট থেকে কথা বের করার চেষ্টা করো না কেন, লাভ কিছু হবে না। তোমাদের মতো বদমাশ চরিয়েই আমি খাই। এখন মানে মানে বিদেয় হও।”