নাকের ডাকের মধ্যেই বিষ্ণুরাম অভ্যাসবশে বলে উঠল, “বটে!”
“তবে আর বলছি কী বড়বাবু! চোখ বুজে আছেন বটে, লোকে দেখলে ভাববে ঘুমোচ্ছেন, কিন্তু এলাকার শান্তি বজায় রাখতে আপনি যে দু’চোখের পাতা কখনও এক করেন না সেটা শুধু আমরা কয়েকজন ভুক্তভোগীই জানি।”
“বলে যা।”
বিগলিত হয়ে লোকটা বলল, “আজ্ঞে। বলব বলেই আসা। আপনার চাটা ভাঙলে ধীরেসুস্থে বলা যাবে।”
বিষ্ণুরাম রক্তচক্ষু মেলে চেয়ে ঘড়ি দেখল। বলল, “বারোটা বাজে যে! আমার তো এখন খিদে পাওয়ার কথা।”
“আজ্ঞে, পেয়েছেও। কাজেকর্মে ব্যস্ত থাকেন, আপনার কি আর নাওয়া-খাওয়ার কথা খেয়াল থাকে? শরীরটা হয়তো এখানে পড়ে আছে, আপনি কি আর হেথায় আছেন! হয়তো শরীরটা ফেলে রেখে আপনি এখন অশরীরে কালীপদর আমবাগান পাহারা দিচ্ছেন। কালীপদর আমবাগানে এবার আমের গুটিও ধরেছে কেঁপে, দুষ্টু ছেলে আর হনুমানের উৎপাতে কালীপদ জেরবার। কিংবা হয়তো সত্যগোপালের বাড়িতে যে-চোরটা ক’দিন আগে ঢুকে দুটো ফুলদানি নিয়ে গিয়েছিল তারই পিছু-পিছু ধাওয়া করে
আলায় বালায় ঘুরে বেড়াচ্ছেন। কিংবা যে-দুটো সন্দেহজনক লোক ক’দিন হল ময়নাগড়ে ঘুরঘুর করে বেড়াচ্ছে তাদের খেদিয়ে নিয়ে তেপান্তরের মাঠ পার করে দিচ্ছেন। তাই বলছিলুম, ওই দেহে কি আর খিদেতেষ্টা আছে? আছে শুধু কাজ, শুধু কর্তব্য, শুধু দায়-দায়িত্ব। দারোগা মানে তো ধরুন একরকম দেশের রাজাই।”
বিষ্ণুরাম একটা প্রকাণ্ড হাই তুলে বলল, “দ্যাখ নবু, তোর একটা দোষ কী জানিস? বড্ড বেশি কথা কয়ে ফেলিস। আজই যদি সব কথা বলিস তাহলে কালকের জন্য থাকবে কী?”
নবু ভারী গ্যালগ্যালে হয়ে বলল, “আজ্ঞে আপনার কথা ভাবলেই আমার কেমন বেগ এসে পড়ে। সামলাতে পারি না।”
“দ্যাখ তোর বলা-কওয়া কিছু খারাপও নয়, আর উচিত কথাই বলিস। শুনতে ভালও লাগে। এই যে সেদিন তুই আমার তৃতীয় নয়ন, ষষ্ঠ ইন্দ্রিয়, জাগ্রত বিবেক আর ব্যাঘ্র-বিক্রমের কথা বলছিলি সেগুলো হয়তো তেমন মিথ্যেও নয়। তবু ভাবি কী জানিস! ভাবি, সত্যিই কি তাই? নবুটা হয়তো বাড়িয়ে বলছে। অত গুণ থাকলে কি আমি এই অখদ্দে ময়নাগড়ে পড়ে আছি! কবে প্রমোশন পেয়ে ভাল জায়গায় চলে যেতাম।”
চোখ বড় বড় করে ডুকরে উঠে নবু বলল, “আপনি চলে গেলে যে ময়নাগড়ের অবস্থা শচীমাতার মতো হয়ে দাঁড়াবে। কাঁদে ময়নাগড় কোথা বিষ্ণুরাম, প্রতিধ্বনি বলে থাম, থাম, থাম, ময়নাগড়ে আর নাই ঘনশ্যাম। সেদিন পরেশ পালও বলছিল, বিষ্ণু দারোগা চলে গেলে ময়নাগড় জঙ্গলের রাজত্ব হয়ে উঠবে। দিনে-দুপুরে বাঘ ডাকবে, গণ্ডায় গণ্ডায় গণ্ডার রাস্তায় ঘাটে ঘুরে
বেড়াবে, হাতির পাল ঢুকে পড়বে ঘরেদোরে।”
“বলে নাকি?”
“তা বলবে না? তখন ঘরে ঘরে অরন্ধন হবে, মেয়েরা চুল বাঁধবে না, ছেলেরা টেরি কাটতে ভুলে যাবে, জটাধারী বোষ্টম ন্যাড়া হয়ে ঘুরে বেড়াবে। অশোকবনে সীতার মতো অবস্থা হবে ময়নাগড়ের।”
বিষ্ণুরাম ফোঁস একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলে, “সরকার বাহাদুর কি আর চিরকাল আমাকে এখানে রাখবে রে? চারদিক থেকেই যে ডাক আসছে। উত্তরমেরু মোরে ডাকে ভাই, দক্ষিণমেরু টানে। তা সেসব কথা থাক। বলি চারদিককার খবরটবর আনলি কিছু?”
একগাল হেসে ঘাড়টাড় চুলকে নবু বলে, “আজ্ঞে, খবর তো মেলা। ননীগোপালবাবুর ছাগল হারিয়েছে, বিন্ধ্যবাসিনী দেবী বেলপানা খেতে গিয়ে তার বাঁধানো দাঁত গিলে ফেলেছেন, মদন সাঁপুই কাঁঠাল পাড়তে গিয়ে গাছ থেকে পড়ে হাত ভেঙেছে, গণেশ তফাদার কেলো মণ্ডলকে হনুমান বলায় কেলো মণ্ডল তাকে জাম্বুবান বলেছে এবং দু’জনে হাতাহাতি লেগে যাওয়ায় গণেশের তিন ছেলের সঙ্গে কেলোর পাঁচ ছেলের মারপিট হয়েছে। চুরি ছিচকেমির কয়েকটা ঘটনা আছে বটে, কিন্তু সেগুলো আপনার পাতে দেওয়ার যুগ্যি নয়। আর নয়নপুর ঘোষবাড়ি, কালিরহাটে নরেন দাসের বাড়ি, পঞ্চাননতলায় গিরিন পোদ্দারের বাড়িতে ডাকাতি হয়েছে। তবে ওসব আপনার গায়ে মাখবার দরকার নেই। ঘোষ, দাস আর পোদ্দারেরা আপনার কথামতো ডাকাতদের ক্ষমাঘেন্না করেও দিয়েছে। তবে কিনা বড়বাবু, দুটো সন্দেহজনক লোক বাড়ি বাড়ি ঘুরে বেড়াচ্ছে। একটার তো ঘটোৎকচের মতো চেহারা, অন্যটা কাপ্তেনের মতো।”
“তারা কারা?”
“বলছে কোনও রাজবাড়ির লোক। কিন্তু ব্যাপারটা সুবিধের ঠেকছে না। তারা চোরাই জিনিস খুঁজছে।”
বিষ্ণুরাম তাচ্ছিল্যের ভঙ্গিতে বলল, “তা খুঁজছে খুঁজুক না। তাদের ঘাঁটানোর দরকারটা কী? ঘাঁটাঘাঁটি করতে গেলে শেষে থানায় এসে আবদার করবে চোরাই জিনিস খুঁজে দিতে। শান্তিতে কি থাকার জো আছে রে? মানুষের যেন আর নালিশের শেষ নেই। এই তো সেদিন সুধন্যবাবু নস্যির ডিবে খুঁজে পাচ্ছেন না বলে থানায় এফ আই আর করতে এসেছিলেন।
হাত কচলে নবু বলল, “এ একেবারে ন্যায্য কথা। মাথামোটা লোকগুলোর তো আক্কেল নেই। তারা বোঝেও না যে, বড় দারোগার গুরুতর সব কাজ থাকে। ছোটখাটো ব্যাপারে নজর দেওয়ার তার সময় কোথায়! তবে কিনা বড়বাবু, অভয় দেন তো শ্রীচরণে একটু গুহ্য কথা নিবেদন করি। কয়েকদিন আগে একটা পাগলামতো দাড়ি-গোঁফওয়ালা তোক বাড়ি বাড়ি ঘুরে হরেকরকম চোরাই জিনিস বিক্রি করছিল। সে বলেছিল বটে যে, কোনও রাজবাড়ি থেকে নিলামে কিনে এনেছে, কিন্তু কথাটা বিশ্বাস করার মতো নয়। ভারী শস্তায় দিচ্ছিল বলে লোকে কিনেও নিচ্ছিল। লোকটা যে পাগল আর গবেট তাতে সন্দেহ নেই। তার কারণ, তিনখানা নাকি সোনার রেকাবি– তা ধরুন পঞ্চাশ ভরি ওজন তো হবেই- মাত্র দেড়শো টাকায়, আর দুখানা হিরের আংটি মাত্র একশো টাকায় আপনার বাড়ির গিন্নিমার কাছেই বেচে গেছে।”