দিনতিনেক বাদে গোবিন্দলাল থানায় গিয়েছিল ঘটি চুরির নালিশ জানাতে।
বিষ্ণুরাম হাসিহাসি মুখ করে বলল, “মানুষের সবচেয়ে বড় গুণ কী জানো?”
“আজ্ঞে! জানি, তবে ঠিক স্মরণ হচ্ছে না।”
“মানুষের সবচেয়ে বড় গুণ হল ক্ষমা। সারাদিন যত পারো ক্ষমা করে যাও। যাকে সুমুখে পাবে তাকেই ক্ষমা করে দেবে।”
“যে আজ্ঞে, সে না হয় করলুম, কিন্তু এই ঘটিচুরির বৃত্তান্তটা একটু শুনুন।”
“যিশু খ্রিষ্ট কী বলেছিলেন?”
“আজ্ঞে, জানতুম, তবে এখন ঠিক স্মরণ হচ্ছে না। ইংরিজিতে বলতেন তো!”
“যিশু বলেছিলেন, কেউ তোমাকে এক গালে চড় মারলে আর এক গাল এগিয়ে দাও। সে গালেও যদি চড় মারে তবে ফের আগের গালটা এগিয়ে দাও। যদি সে গালেও মারে তবে ফের দ্বিতীয় গাল এগিয়ে দাও। সেও চড় মেরে যাবে তুমিও গালের পর গাল এগিয়ে দিতে থাকবে। এইভাবে মারতে মারতে আর কত পারবে সেই চড়বাজ! দেখবে সে একটা সময়ে চড় মারতে মারতে হেদিয়ে পড়ে মাটিতে বসে হ্যাঁ-হ্যাঁ করে হাঁফাচ্ছে। বুঝলে?”
“আজ্ঞে, জলের মতো। তবে কিনা ঘটিচোর আমাকে চড় মারেনি, তাকে জাপটে ধরেছিলুম বলে সে আমাকে কামড়ে দিয়ে পালিয়ে গেছে।”
“একটা টেট ভ্যাক ইনজেকশন নিয়ে নাও। আর ঘটিচোর তোমার একটা ঘটি নিয়ে গেছে, তাতে কী? তাকে পেলে আর একটা ঘটি দিও। গীতায় ভগবান শ্রীকৃষ্ণ কী বলেছেন?”
“আজ্ঞে, ঠিক স্মরণ হচ্ছে না।”
“শ্রীকৃষ্ণ বলেছেন, নমো হে নমো, ক্ষমো হে ক্ষমো, পিত্তরসে চিত্ত মম… আর কী সব আছে যেন। মোট কথা মানুষের শ্রেষ্ঠ গুণ হল, ক্ষমা। মনে থাকবে তো!”
“আজ্ঞে, মৃত্যুর দিন অবধি মনে থাকবে। ঘটিচুরির শোক কি সহজে ভোলা যায়! যতবার ঘটিচুরির কথা মনে পড়বে ততবার আপনার কথাও মনে পড়বে।”
গত দশবছর ধরে বিষ্ণুরাম চারদিকে ক্ষমার গঙ্গাজল ছিটিয়ে ছিটিয়ে জায়গাটাকে একেবারে জব্দ করে রেখেছে। থানায় বড় কেউ একটা নালিশ করতে আসে না। চোরছ্যাচড়-ডাকাতরা বিষ্ণুরামকে খুবই শ্রদ্ধাভক্তি করে। কাজকর্ম তেমন না থাকায় বিষ্ণুরাম আর তার সেপাইরা যে যার চেয়ার বা টুলে বসে দিবানিদ্রাটি সেরে নিতে পারে।
আজ বিষ্ণুরামের বউ সকালে ঢাকাই পরোটা আর মাংসের ঘুঘনি করেছিল। সুতরাং সকালে গুরুতর জলযোগের পর বিষ্ণুরাম থানায় এসে নিজের চেয়ারটিতে বসে ঢুলছে। কোমরের পিস্তল সমেত বেল্টটি খুলে টেবিলের ওপর রাখা। গুরুভোজনের পর বিষ্ণুরাম কোনও দিনই কোমরে বেল্ট পরা পছন্দ করে না।
একটু বেলার দিকে রোগামতো একটা ক্যাকলাস চেহারার লোক ভারী সন্তর্পণে নিঃশব্দে থানায় ঢুকল। পরনে পাজামা, গায়ে একখানা সবুজ কুর্তা, মাথায় জরি বসানো একটা পুরনো কাশ্মীরি টুপি। থুতনিতে একটু ছাগুলে দাড়ি আছে, চিনেদের মতো গোঁফজোড়া দু’দিকে ঝুল খেয়ে আছে। মুখে একখানা হাসি, বড় বড় দাঁতে পানের ছোপ।
বিষ্ণুরামের ঘরে ঢুকে সে একটা গলা খাঁকারি দিয়ে ভারী বিগলিত মুখে বলল, “বড়বাবু কি চোখ বুজে আছেন?”
বিষ্ণুরাম ঘুমের মধ্যেই জবাব দিল, “আছি।”
“বুজেই কি থাকবেন?”
“থাকব।”
“হেঃ হেঃ, আপনি যে বোজা চোখেও সব দেখতে পান তা কে
জানে! শুধু দেখা! দু খানা করে চোখ তো আমাদেরও আছে, কিন্তু কতটুকুই বা দেখি আমরা! গোরুকে মোষ দেখছি, মেয়েছেলেকে ব্যাটাছেলে দেখছি। কালোকে সাদা দেখছি। পূর্ণিমাকে অমাবস্যা দেখছি, পিসেকে জ্যাঠা দেখছি, সাপকে বেজি দেখছি। চোখ থেকেও নেই। আর লোকে বলে, বিষ্ণু দারোগাকে দেখে মনে হয় বটে যে, ঘুমিয়ে আছে, কিন্তু তার দু খানা চোখ হাটে মাঠে ঘাটে ঠিক ঘুরে ঘুরে বেড়াচ্ছে। এই তো সে দিন মদন সরখেল বলছিল, গোরু বেচে টাকে টাকা নিয়ে ফেরার সময় মাঝরাত্তিরে পালঘাটের শ্মশানের কাছে বটতলায় অন্ধকারে দু’খানা জ্বলন্ত চোখকে ঘুরে ঘুরে চারদিকে নজর রাখতে দেখেছে। বলছিল টাকে গোরু বিক্রির টাকা ছিল বলে ভয়ে ভয়ে আসছিলুম বটে, বিষ্ণু দারোগার চোখ দুটো দেখেই ভয় কেটে গেল। মনে হল আর কীসের ভয়! বিষ্ণু দারোগার জয়।”
“বলে নাকি?”
“তা বলবে না? দিনু কুণ্ডুও তো বলল, ভাই, বাড়িতে জামাই এসেছে বলে রোজকার মতোই গিন্নীর নথ বন্ধক রেখে বাজারে গিয়ে একটা ইলিশ মাছ আশি টাকা দিয়ে কিনে এক হাতে আনাজপাতি অন্য হাতে মাছের থলে নিয়ে ফিরছি। ফেরার পথে শীতলার থানে পেন্নাম করব বলে মাছের থলিটা বাইরের রকে রেখে জুতো ছেড়ে মন্দিরে ঢুকেছি। এমন সময়ে ন্যাড়া পোদ্দারের সঙ্গে দেখা। পোদ্দারের পো এমনিতেই বেশি কথা কয়। সেদিন আবার তার পিসশ্বশুরের বাতব্যাধির কথা পেড়ে ফেলায় কিছুতেই ছাড়াতে পারি না। যাই হোক ওইসব কথাবার্তার ফাঁকেই মাছের কথা বেবাক ভুলে বাড়ি আসতেই গিন্নি যখন চিল-চেঁচানি চেঁচিয়ে উঠল, ওকী গো, জামাই এয়েছে বলে মাছ আনতে পাঠালুম নথ বাঁধা দিয়ে, আর তুমি খালি হাতে ফিরে এলে যে বড়! তখন খেয়াল হল, তাই তো, মাছটা তো শীতলা মন্দিরের বাইরের রকে ফেলে এসেছি! চটকা ভাঙতেই ছুট, ছুট! গিয়ে কী দেখলুম জানো? বললে বিশ্বাস হবে না, যেমনকে তেমন থলিবন্দি হয়ে পড়ে আছে, গাঁয়ে আঁচড়টুকু লাগেনি। কুকুর-বেড়াল বা কাক পক্ষী কাছেও ঘেঁষেনি। আর দেখলুম বি দারোগার দুখানা বাঘা চোখ আম গাছটার ওপর বসে মাছটার ওপর নজর রাখছে। যাতে কেউ মাছের কেশাগ্রও স্পর্শ করতে না পারে।”