“সেটাও তো ভয়ের কথা।”
“তোর এই ভাঙা বাড়ির দিকে তারা নজরও দেবে না বটে, তবু সাবধান থাকা ভাল। আসলে তারা একটা জিনিসই হন্যে হয়ে খুঁজে বেড়াচ্ছে। সেটা পেয়ে গেলে অন্য জিনিসগুলো নিয়ে তারা বিশেষ মাথা ঘামাবে না।”
“সেটা কী জিনিস বাবা?”
শ্রীনিবাস একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল, “হ্যাঁ রে, নয়নতারা এত দেরি করছে কেন বল তো!”
“আজ্ঞে, এ-বাড়িতে তো বহুঁকাল মান্যগণ্য কেউ আসেনি। আজ আপনার সম্মানে বোধহয় ভালমন্দ কিছু রাঁধবে।”
“অ। তা ভাল।”
শ্রীনিবাসের পা আরও জোরে দাবাতে দাবাতে পরাণ বলল, “জিনিসটা কী তা এই বেলা বলে ফেলুন বাবা। নয়নতারার সামনে গুহ্যকথাটথা না বলাই ভাল। মেয়েদের সামনে গুহ্যকথা বললে বড় ভজঘট্ট লেগে যায়। ওদের পেটে কথা থাকে না কি না, পাঁচকান হয়ে পড়ে।”
“অত হুড়ো দিচ্ছিস কেন রে? সব কথা উপর্যুপরি বলে ফেলাই কি ভাল? কথারও তত দিনক্ষণ, লগ্ন আছে, নাকি? যখন তখন যেমন তেমন কথা বললেই তো হবে না। ভাল করে ভেবেচিন্তে নিকেশ করে বলতে হবে। একটু জিরোই, তারপর চাট্টি খাই, তারপর একটু ঘুমনোও তো দরকার বুড়ো মানুষটার নাকি? বিছানাপত্তরের যা ছিরি দেখছি তাতে ঘুমটাই কি আর হবে?”
শশব্যস্ত পরাণ বলল, “চিন্তা নেই বাবা, মাচানের ওপর আরও কয়েকটা বস্তা পেতে নরম বিছানা করে দিচ্ছি। আরামে শোবেন। আমরা না হয় পাশের ঘরে মাদুর পেতে ঘুমোব।”
“তা সেই ব্যবস্থাই ভাল। লোক দুটোর গতিবিধির ওপর নজর রাখতে তোর বাড়িতেই কয়েকদিন থানা গেড়ে থাকতে হবে। এই একশোটা টাকা রাখ। কাল গিয়ে ভাল করে বাজার করে দু’দিন ভালমন্দ খা দিকি। রাতের কারিগরদের ভালমন্দ খেতে হয়, নইলে এ কাজের হ্যাপা সামলাবি কী করে। ওই হাড়গিলে ল্যাকপ্যাকে কমজোর চেহারায় যে দশটা লোকের কিলও হজম করতে পারবি না। তোর মতো বয়সে আমাকে একশো লোক মিলে হাটুরে মার দিয়েও কিছু করতে পারেনি। পাগলুর হাটে তো একবার বাঁশডলা দেওয়ার পর পুকুরের জলে চুবিয়ে রেখেছিল। প্রাণায়ামের জোরে প্রাণবায়ুটুকু আটকে রাখতে পেরেছিলুম। বুঝেছিস?”
৩. পেটে কিছু পড়লেই
পেটে কিছু পড়লেই বিষ্ণুরাম দারোগার ঘুম পায়। মোটাসোটা মানুষ, খোরাকটাও একটু বেশিই। তা বলে বিষ্ণুরামকে কেউ অলস ভাবলে ভুল করবে। বছরতিনেক আগে যখন এখানে প্রথম এল, তখন এসেই ট্র্যাড়া পিটিয়ে পাঁচ গাঁয়ের লোককে জড়ো করে একটা বক্তৃতা দিয়েছিল। সেই অগ্নিবর্ষী বক্তৃতায় বলেছিল, “ভাইসব, এলাকার শান্তি যেন বজায় থাকে। আমি জানি, চোর ভারতবাসী, ডাকাত ভারতবাসী, খুনি ভারতবাসী, জোচ্চোর এবং ঘুষখোর ভারতবাসী আমার ভাই। তাদের ধমনীতে যে রক্ত বইছে, আমার ধমনীতেও সেই রক্তই বইছে। তাদের শরীরের এক ফোঁটা রক্তপাত হলে সেটা হবে আমারই রক্তপাত। তাদের দণ্ডদান করা মানে আমাকেই দণ্ডদান করা। তাই কবি বলেছেন, দণ্ডিতের সাথে দণ্ডদাতাও যখন কাঁদেন তখন সর্বশ্রেষ্ঠ সে বিচার। সুতরাং কবির সঙ্গে গলা মিলিয়ে আমিও বলতে চাই, আজ থেকে যেন ময়নাগড় এবং আশপাশের অঞ্চলে বিচারের বাণী নীরবে নিভৃতে কাঁদে। তাই আমি বলি, এসো চোরগণ, শুচি করি মন, ধরো ডাকাতের হাত, মোর অভিষেকে এসো এসো ত্বরা, অকারণে কেউ পোড়ো না কো ধরা, সবার হরষে হরষিত মোরা দুঃখ কী রে?
“আমি তাদের কবির অমোঘ বাণী স্মরণ করিয়ে দিতে চাই, কারার ওই লৌহকপাট, ভেঙে ফ্যাল কর রে লোপাট, রক্তজমাট শিকলপূজার পাষাণবেদী। আমি জানি অনেকেই পাখির নীড়ের মতো চোখ তুলে আমাকে প্রশ্ন করবেন, এতদিন কোথায় ছিলেন? আমি তাদের বলব, তোমার মিলন লাগি আমি আসছি কবে থেকে। বাউলের গলার সঙ্গে গলা মিলিয়ে আজ আমার বলতে ইচ্ছে করছে, আমি আইলাম রে, খাটাইশ্যা বৈরাগী, রূপে গুণে ষোলো আনা ওজনে ভারী। আমি জানি এই হানাহানি, কানাকানি এবং টানাটানির যুগে শান্তির ললিত বাণী শুনাইবে ব্যর্থ পরিহাস। তবু ভাইসব, শত্রুপক্ষ আচমকা যদি ছোঁড়ে কামান, বলব বৎস, সভ্যতা যেন থাকে বজায়, চোখ বুজে কোনও কোকিলের দিকে ফেরাব কান। বিশদ করে বলতে গেলে বলতে হয়, ধরুন দুয়ার এঁটে ঘুমিয়ে আছে পাড়া, হঠাৎ শুনলেন রাতের কড়া নাড়া। হেঁড়ে গলায় কেউ ডেকে উঠল, অবনী বাড়ি আছ? খবর্দার জবাব দেবেন না কিন্তু, দরজাও খুলবেন না। তবে যদি সে নিতান্তই দরজা ভেঙে টেঙে ফেলে তা হলে চটবেন না। হেসে বলবেন, ভেঙেছ দুয়ার এসেছ জ্যোতির্ময়, তোমারই হউক জয়।”
বক্তৃতা শুনে ভয় খেয়ে পঁচাশি বছরের নন্দকিশোর নব্বই বছর বয়সী কৃষ্ণকিশোরকে বললেন, “এ তো দেখছি একটা চোরডাকাতের স্বর্গরাজ্য হয়ে উঠল!”
কৃষ্ণকিশোর কানে শোনেন না। একগাল হেসে বললেন, “তাই নাকি? আমি তো আগেই বলেছিলুম, এই দারোগা গাঁয়ে পা দেওয়ার পরই আমার বাঁ চোখ নাচছে। অতি শুভ লক্ষণ, বাঁ হাঁটুর ব্যথাটাও তেমন টের পাচ্ছি না। হপ্তাখানেক আগে আমার দুধেল গাই নন্দরানি নিরুদ্দেশ হয়ে যায়। গতকাল নন্দরানি দিব্যি গুটিগুটি ফিরে এসেছে। চারদিকেই শুভ লক্ষণ দেখতে পাচ্ছি। আর বক্তৃতাটাও কেমন বলো! সেই উনিশশো তেইশে গাঁধীজির বক্তৃতা শুনেছিলুম, আর এই শুনলুম, কী তেজ, কী বীরত্ব, কী বলব রে ভাই, বক্তৃতার হলকায় তো কানে আঙুল দিতে হয়।”