শ্রীনিবাস ফোঁস করে একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বলল, “রাজা না হলেও রাজার কাজেই রিটায়ার ভেঙে এই বুড়ো বয়সে বেরোতে হল, বুঝলি?”
“উরেব্বাস! তাই নাকি? রাজার কাজ মানে তো ভাসাভাসি কাণ্ড! কথায় বলে, মারি তো গণ্ডার, লুটি তো ভাণ্ডার। তা রাজা খরচাপাতি কেমন দিচ্ছে বাবা?”
শ্রীনিবাস ফের একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বলল, “রাজাদের আর সেই দিনকাল কি আছে রে হাবা গঙ্গারাম? রাজা দিগিন্দ্রনারায়ণের বাপমশাই রাজা ক্ষিতীন্দ্রনারায়ণ গরম ভাতে দু’হাতা করে ঘি খেতেন, তাঁর এক্কা গাড়ির ঘোড়ার লেজে দামি আতর মাখানোনা হত যাতে ঘোড়া ছুটলে একা গাড়িতে বসে রাজামশাই ভুরভুরে গন্ধ পান, আসল পাকা সোনার সুতো দিয়ে রাজার নাগরায় নকশা করা হত, তিনদিনের বেশি এক জোড়া নাগরা পরতেন না, চাকরবাকরদের দান করে দিতেন। সেসব দিন তো আর নেই। দিগিন্দ্রনারায়ণের তো এখন পোলাও খেতে ইচ্ছে হলে রানিমা সর্ষের তেলে ভাত ভেজে দেন, রাজবাড়িতে এখন ছেঁড়া গামছাখানাও সেলাই করে ব্যবহার করা হয়, রাজমাতা মিতব্যয়িনী দেবীকে আর আলাদা করে একাদশী করতে হয় না, রোজই তাঁর একাদশী।”
“এঃ হেঃ, আপনার মতো গুণী মানুষ এরকম একটা দেউলে রাজার হয়ে খাটছেন কেন বাবা? দেশে কি রাজাগজার অভাব?”
“রাজার হয়ে খাটছি তোকে কে বলল?”
“তা হলে এই যে বললেন রাজার কাজ!”
“তা বলেছি বটে, তবে তার মানে রাজার হয়ে খাটা নয় রে। মানেটা একটু খটোমটো, তুই ঠিক বুঝবি না। তবে কাজটা রাজবাড়ি সংক্রান্তই বটে।”
পরাণের চোখদুটো এবার ভারী জুলজুল করে উঠল। একগাল হেসে সে বলল, “তাই বলুন! এবার তা হলে রাজবাড়ি খালাস করবেন! এ না হলে ওস্তাদ! আপনার মতো মান্যগণ্য ওস্তাদের কি আর গেরস্তবাড়ির কাজে মানায়! প্রাতঃস্মরণীয় মানুষ আপনি। আর পুরনো রাজবাড়িগুলোয় মেলা কোনা-ঘুপচি, চোরকুঠুরি, কোথায় গুপ্তধন আছে কে জানে বাবা। তা বাবা, আপনার একজন স্যাঙাতট্যাঙাত দরকার নেই? আপনার পায়ের নখেরও যুগ্যি নই বটে, কিন্তু সোদানা তো ওজনদার জিনিস, আপনি বুড়ো মানুষ অত কি বইতে পারবেন? সেসব না হয় আমিই বয়ে দেবখন।”
“সেসব হবেখন। অত উতলা হচ্ছিস কেন? তার আগে বল তো, তুই কি ইংরিজি জানিস?”
হাত কচলে লাজুক হেসে পরাণ বলে, “কী যে বলেন। বাংলাটাই ভাল করে আসেনা তো ইংরিজি! তবে কিনা বলা কওয়ার দরকারও পড়ে না তো। হাত-পা সচল থাকলেই হল।”
মাথা নেড়ে শ্রীনিবাস বলে, “উঁহু, ওটা কাজের কথা হল না। ভাল কারিগরের সব কিছুই সচল থাকা দরকার। হাত, পা, মগজ, বুলি, কোনটা না হলে চলে?”
“আজ্ঞে, ইংরিজির কথাটা কেন উঠছে বাবা? জানলে কিছু সুবিধে হবে?”
“তা হবে বইকী, ওই যে ফুলদানি দুটো চুরি করে এনেছিস, কখনও ভাল করে উলটেপালটে দেখেছিস?”
পরাণ অবাক হয়ে বলে, “না তো! কাঁচের ফুলদানি দেখে বউটা এমন মুখনাড়া দিল যে, আর ওটার দিকে ফিরেও তাকাইনি। বউ তো ফেলে দিতেই চেয়েছিল, কী ভেবে ফেলেনি।”
“ঘটে বুদ্ধি থাকলে ফুলদানি দুটো উলটে দেখলে দেখতে পেতিস, ওগুলোর নীচে ইংরিজিতে লেখা আছে, আজ থেকে দেড়শো বছর আগে ও জিনিস বিলেতে তৈরি হয়েছিল। স্ফটিক কাঁচের তৈরি। সমঝদার খদ্দের যদি পাস, কত দাম দিতে পারে জানিস?”
বড় বড় চোখে হাঁ করে কিছুক্ষণ চেয়ে থেকে শশব্যস্ত পরাণ বলে, “কত হবে বাবা, একশো দেড়শো?”
‘দূর পাগল! একশো দেড়শো কী রে? যদি সাহেব খদ্দের পাস তবে হেসেখেলে দশ থেকে পনেরো হাজার টাকা। দিশি খদ্দের কিছু কম দিতে চাইবে, তাও ধর ওই আট-দশ হাজার।”
“তবে যে আপনি দশ টাকায় বেচে দিলেন!”
শ্রীনিবাস একটু হেসে বলল, “বেচব না তো কি চোরাই জিনিস বয়ে বেড়াব? আর বেচা মানে কি আর সত্যিই বেচা নাকি? ও হল গচ্ছিত রাখা। যেমন ব্যাঙ্কে লোকে টাকা রাখে আবার দরকার মতো তুলে নেয়, এও হল তাই। এ-গাঁয়ের ঘরে ঘরে অমন আমার কত জিনিস গচ্ছিত রাখা আছে। দরকার মতো সরিয়ে নেব বলেই রেখেছি।”
“পায়ের ধুলো দিন ওস্তাদ!” বলে ভক্তিভরে ফের শ্রীনিবাসের পায়ের ধুলো নিয়ে পরাণ শশব্যস্তে বলল, “দেখেছেন বাবা নয়নতারার কাণ্ডটা! অত দামি জিনিস কেমন অচ্ছেদ্দায় কুলুঙ্গিতে তুলে রেখেছে! ষষ্ঠী গুণের মেয়ে হয়ে তার আক্কেলটা দেখলেন! পড়ে ভাঙবে যে!”
“অত উতলা হোসনে। তোর হাত কাঁপছে যে! উত্তেজনার বশে ফুলদানির ওপর গিয়ে হামলে পড়লে তোর হাতেই ভাঙবে। বউমা আসুক, সাবধানে তুলে রাখবে’খন।”
“না বাবা, দামি জিনিসের অমন অযত্ন সহ্য হয় না।”
একটু হেসে শ্রীনিবাস বলে, “দামি জিনিস বলে বুঝতে পারলে কি আর অযত্ন করত? কোন জিনিসের কী দাম তা ক’জন বোঝে বল দিকি! তাই তো বলছিলাম, কারিগর হতে গেলে হাতে পায়ে দড় হলেই হয় না, মগজ চাই, চোখ চাই, পেটে একটু বিদ্যে চাই।
গদগদ হয়ে পরাণ বলে, “আপনাকে যখন পেয়ে গেছি, এবার সব শিখে নেব।”
“শোন হতভাগা, হুটপাট করার দরকার নেই, ও দুটো জিনিস একটু ঢাকা চাপা দিয়ে রাখিস। দুটো লোক কাল থেকে ওসব চোরাই জিনিসের খোঁজে এ তল্লাটে ঘুরঘুর করছে।” পরাণ প্রায় লাফিয়ে উঠে বলে, “সর্বনাশ। তা হলে উপায়?”
“ঘাবড়াসনি। তারা দুটিও তোর মতোই মর্কট। এসব জিনিসের মর্ম তারাও বোঝে না। ডবল দাম দিয়ে কিনে নেবে বলে সবাইকে ভরসা দিচ্ছে। আসলে ডবল দাম দেওয়ার মুরোদও তাদের নেই। তারা শুধু খোঁজ নিচ্ছে কার বাড়িতে কোন জিনিসটা আছে। জেনে নিয়ে রাতের অন্ধকারে মাল সাফাই করবে।”