পরাণ মাদুরের আর এক দিকটায় বসে বলল, “তা যাচ্ছে একটু। তবে চিরকাল তো এরকমধারা যাবে না।”
নয়নতারা ফোঁস করে উঠে বলল, “চিরকাল তো ওই কথাই শুনে আসছি। দিন নাকি ফিরবে। তা দিন আর কবে ফিরবে, চিতেয় উঠলে?”
লোকটা তার কামিজের পকেট থেকে পঞ্চাশ টাকার একটা নোট বের করে নয়নতারার দিকে চেয়ে বলল, “ঝগড়া কাজিয়ায় কাজ নেই মা, তুমি বরং ওই সামনের মুদির দোকান থেকে যা যা লাগবে কিনে আনো৷”
নয়নতারা লজ্জা পেয়ে বলে “না, না আপনি টাকা দেবেন কেন?”
“আহা, আমি তোমার বাপের মতোই। তা ছাড়া, এই পরাণ দাসকে তুমি যত অপদার্থ ভাবো তত নয়। ওর বরাতটাই খারাপ। নইলে ও সত্যিই গুণী লোক। এ টাকাটা গুণী মানুষের নজরানা বলেই ভাবো না কেন?”
নয়নতারা নোটটা নিয়ে পরাণের দিকে একটা জ্বলন্ত দৃষ্টিতে চেয়ে বলল, “গুণীর যা ছিরি দেখলুম তাতে পিত্তি জ্বলে গেল বাবা। এই তো গতকালই খগেন চোরের বউ অতসী এসে তার নতুন গোমেদের আংটি দেখিয়ে কত কথা বলে গেল। বলল, ও মা! পরাণদার মতো লাইনের নামকরা লোকের বউ হয়ে এখনও তুই টিনের ঘরে থাকিস, আমার তো দোতলা উঠে গেল। আরও ঠেস দিয়ে কী বলল জানেন? বলল, তোর দেখছি গায়ে সোনাদানা নেই। ঘরে তেমন বাসনপত্র নেই, কাজের ঝি নেই! কেন রে, পরাণদার কি হাতে-পায়ে বাতে ধরেছে নাকি?”
বুড়ো লোকটা খুব মন দিয়ে সব শুনে মাথা নেড়ে বলল, “হ্যাঁ মা, পরাণের দিনকাল খারাপই যাচ্ছে বটে। তবে আমি যখন এসে পড়েছি তখন আর চিন্তা নেই। তুমি একটু রান্নাবান্নার জোগাড় করো তো দেখি। আমি আবার খিদেটা তেমন সইতে পারি না।”
“এই যে যাচ্ছি বাবা।” বলে নয়নতারা চলে গেল।
পরাণ জুলজুল করে চেয়ে ঘটনাটা দেখে নিল। তারপর একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল, “তুমি কে বট হে? মতলবখানা কী? বলি পুলিশের চর নও তো!”
বুড়ো হো হো করে হেসে উঠে বলল, “ওহে পরাণচন্দর, পুলিশেরও ঘেন্নাপিত্তি আছে। তারা ছুঁচো মেরে হাত গন্ধ করতে যাবে কেন বলো তো! এখন অবধি এমন একটা লাগসই কাজ করতে পারোনি যাতে পুলিশের নজরে পড়তে পারো। তোমাকে তারা চোর বলে পাত্তাই দেয় না। বলি চুরি বিদ্যেরও তো বি এ, এম এ আছে, নাকি? তা তুমি তো দেখছি এখনও প্রাইমারিটাই ডিঙোতে পারোনি।”
ভারী লজ্জা পেয়ে পরাণ অধোবদন হয়ে বলল, “তা কী করা যাবে বলো! আমি কাজে হাত দিলেই কেমন যেন ভণ্ডুল হয়ে যায়। তা তুমি লোকটি কে? কোথা থেকে আগমন? উদ্দেশ্য কী? বলি ছদ্মবেশে ভগবানটগবান নও তো!”
লোকটা ফের অট্টহাসি হেসে বলল, “পঞ্চাশ টাকা ফেললেই যদি ভগবান হওয়া যায় তা হলে তো কথাই ছিল না হে। ওসব নয়। বাপু হে, শ্রীনিবাস চূড়ামণির নাম শুনেছ কখনও?”।
পরাণ তাড়াতাড়ি হাতজোড় করে কপালে ঠেকিয়ে বলল, “তা আর শুনিনি! নমস্য মানুষ। প্রাতঃস্মরণীয়। লোকে বলে শ্রীনিবাস চূড়ামণির শরীর নাকি রক্তমাংস দিয়ে তৈরিই নয়, বাতাস দিয়ে তৈরি। এতকাল ধরে কত বড় বড় সব চুরি করলেন কেউ কখনও ধরতেও পারল না। কোথা দিয়ে ঘরে ঢোকেন, কোথা দিয়ে বেরিয়ে যান। লোকে বুঝতেও পারে না। একবার নাকি ইঁদুরের গর্ত দিয়ে কার ঘরে ঢুকেছিলেন।”
লোকটা মাথা নেড়ে বলল, “আহা, অতটা নয়। তবে হ্যাঁ, আমার বেশ নামডাক হয়েছিল এককালে।”
“অ্যাঁ! আপনি!”
“আপনি-আজ্ঞে করতে হবে না, তুমিটাই চালিয়ে যাও। হ্যাঁ, আমিই শ্রীনিবাস বটে। তবে চুরিচামারি আমি বহুঁকাল ছেড়ে দিয়েছি। কিছুদিন কোচিং ক্লাসে ভাল ভাল চোর তৈরি করতুম। এখন তাও করি না।”
“আজ্ঞে, আমার যে কেমন পেত্যয় হচ্ছে না! মাথা ঘুরছে! বুকের ভিতরে ধকধক! এত বড় একটা মানুষ আমার ঘরে পা দিয়েছে! শাঁখ বাজানো উচিত, উলু দেওয়া দরকার!”
শ্রীনিবাস বরাভয়ের ভঙ্গিতে হাত তুলে বলল, “হবে, হবে। ব্যস্ত হওয়ার দরকার নেই। রয়েসয়ে উলুও দিতে পারো, শাঁখও বাজাতে পারো, তবে সব কিছুরই একটা সময় আছে। ওসব হুট করে করতে নেই।”
“তা হলে একটা পেন্নাম অন্তত করতে দিন।” বলে ভারী ভক্তির সঙ্গে শ্রীনিবাসের পায়ের ধুলো নিয়ে জিবে আর মাথায় ঠেকাল পরাণ। তারপর গদগদ হয়ে বলল, “এ যে কাকের বাসায় কোকিল, এ যে বাঘের ঘরে ঘোগ, এ যে শ্রাদ্ধে বিরিয়ানি, এ যে বদনাতে গঙ্গাজল, এ যে নেউলের নাকে নোলক!” শ্রীনিবাস ধমক দিয়ে বলে, “ওরে থাম থাম হতভাগা! উপমার যা ছিরি তাতে ঘাটের মড়া উঠে বসে।”
“আমার যে বুকের মধ্যে বড় আকুলি ব্যাকুলি, বড় হাঁকপাঁক হচ্ছে! বরং একটু পদসেবা করি, তাতে আবেগটা একটু কমবে।”
“তা করতে পারিস। বেজায় হাঁটা হয়েছে আজ, পা টনটন করছে।”
বলে শ্রীনিবাস মাদুরে শুয়ে ঠ্যাং বাড়িয়ে দিল। পরাণ মহানন্দে পদসেবা করতে করতে বলল, “কাজকর্মে কি আবার নামা হবে বাবা?”
“কেন রে, এই বুড়োটাকে দিয়ে আবার কাজ করাতে চাস কেন? আমার কি রিটায়ার হওয়ার জো নেই?”
“কী যে বলেন বাবা! ভগবান কি রিটায়ার করে, নাকি দেশের রাজা রিটায়ার করে, নাকি ডাক্তার কোবরেজই রিটায়ার করে? তারপর ধরুন যতদূর শুনেছি, বাঘ-সিংহীদেরও রিটায়ার নেই।”
শ্রীনিবাস আরামে চোখ বুজে বলল, “তা তুই আমাকে কোন খাতে ধরছিস? ভগবান, না রাজা, না ডাক্তার, না বাঘ?”
“আজ্ঞে, ভগবান বলেই ধরতুম, তবে পাপ হয়ে যাবে বলে ধরছি না। একটু কম সম করে ওই রাজা বলেই ধরে নিন।”