বাবা কখন কী বলছে তাই নিয়ে মনোজ, সরোজ আর পুতুল উঠোনের এক কোণে দাঁড়িয়ে বাজি ধরছে। যেমন, একবার রাখোবাবু মুখটা অ্যা-এর মতো করে আবার উ-এর মতো করায়
সরোজ বলল, “এখন বাবা ঘেউ করল।”
পুতুল বলে, “দূর! ও তো কুকুরের ডাক। বাবা বলল, ধ্যাততেরি।”
“মোটেই না।” মনোজ বলে, “বাবা ওভাবে ঢেকুর তোলে।”
রাখোবাবু আ করে একটা ই করলেন।
মনোজ বলল, “পাজি।”
পুতুল বলে, “উঁহু। হায় এ কী বলল বাবা।”
সরোজ বলল, “না। বাবা আমাদের বাড়ি থেকে বেরোতে বলছে।”
ব্যায়ামবীর এবং বৈজ্ঞানিক হারধন ভূতে বিশ্বাস করে না। বাড়িতে নানারকম চেঁচামেচি শুনে ল্যাবরেটরি থেকে বেরিয়ে এসে সব ব্যাপারটা ভাল করে বোঝবার চেষ্টা করছিল। কিরমিরিয়া গিয়ে তার পা ধরে কাঁদতে বসল, “ও হারাদাদাবাবু গো, বাড়িতে এ-সব কী হল গো? একটা কাকভূত এসে বড়দাদাবাবুর পৈতে নিয়ে গেল গো। বড়দাদাবাবু কথা বলতে পারবে গো?”
হারাধন কাকটার দিকে চেয়ে বলল, “কাকভূত! কাকভূত! কথাটা কেমন চেনা-চেনা ঠেকছে! অনেকটা চাগম কিংবা লামড়োর মতো!”
এখন হয়েছে কী, হারাধন শুধু ব্যায়ামবীর নয়। সে ব্যায়াম জানে, কুস্তি, বকসিং, জুডো, কারাটে জানে। আবার বৈজ্ঞানিক হিসাবেও রসায়ন, পদার্থবিদ্যা, জীববিদ্যা, বলবিদ্যা এবং উদ্ভিদবিদ্যা ইত্যাদি সব কাজের কাজী। তার গবেষণাগারের পিছনে উদ্ভিদবিদ্যার নানারকম পরীক্ষা চালানোর একটা আলাদা বাগান আছে। সেখানে অনেকগুলো কিম্ভুত গাছ রয়েছে। তার মধ্যে একটা আছে চাগম গাছ, আর একটা লামড়ো। অর্ধেক ধান আর অর্ধেক গমের বীজকে বৈজ্ঞানিক উপায়ে জুড়ে দিয়ে একটা সংকর বীজ তৈরি করে সে তার নাম দিয়েছে চাগম। অর্ধেক লাউবিচির সঙ্গে অর্ধেক কুমড়োবিচি জুড়ে হয়েছে লামড়ো গাছের বীজ। চাগম আর লামড়ো দুটো বীজ থেকেই গাছ বেরিয়েছে বটে, তবে তাতে এখনও কোনও ফসল ধরেনি। চাগম বা লামড়ো কেমন হয় তা জানবার জন্য শহরসুন্ধু লোক অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করছে।
হারাধনের পা ধরে কিরমিরিয়া বিলাপ করছে, “বাড়িতে কাকভূত থাকলে আমি মরে যাব গো। ও হারাদাদাবাবু, আমি মরে গেলে তোমার চাগম দিয়ে লামড়োর ঘণ্টা কে চেখে দেখবে গো?
হারাধন গম্ভীরভাবে কিরমিরিয়ার হাত থেকে পা ছাড়িয়ে নিয়ে নিজের বাগানের দিকে চলে যেতে যেতে বলল, “ওটা কাকভূত নয় রে কিরমিরিয়া। ওটা হয় কাক, না হয় তো ভূত।”
সতীশ ভরদ্বাজ একটা সুস্থ হয়ে বসে রাখোবাবুর জন্য নতুন পৈতে গ্রন্থি দিচ্ছিলেন। শেষ গ্রন্থিটা দিতে দিতে গম্ভীর গলায় বললেন, “ভূত।”
রাখোবাবু সতীশ ভরদ্বাজের হাত থেকে পৈতেটা কেড়ে নিয়ে ৩৮
গলায় পরেই বললেন, “কাক।”
সতীশ ভরদ্বাজ মাথা নেড়ে বললেন, “ভূত। ওকে আমি বিশুদ্ধ সংস্কৃত বলতে শুনেছি নিজের কানে।”
রাখোবাবু বললেন, “কাক। নোংরা, বজ্জাত, পাজি, ছুঁচো একটা কাক। নিজের চোখে দেখেছি।”
সতীশ ভরদ্বাজ বললেন, “ভুল দেখেছেন।”
রাখোবাবু বললেন, “ভুল শুনেছেন।”
সতীশ ভরদ্বাজ বললেন, “না।”
রাখোবাবু বললেন, “আমারও ওই এক কথা। না।”
সতীশ ভরদ্বাজ বললেন, “ওটা যে ভূত নয় তা প্রমাণ করতে পারেন?”
“করছি।” বলে রাখোবাবু পেল্লায় চেঁচিয়ে ডাকলেন, “মনোজ।”
মনোজ গুটিগুটি এগিয়ে বলল, “কী?”
“তোর গুলতিটা নিয়ে আয় তো। কয়েকটা বেশ ভারী দেখে পাথরও আনিস। কাকটার উচিত শিক্ষা হওয়া উচিত।”
মনোজ দৌড়ে তার গুলতি আর কয়েকটা পাথর নিয়ে এল। রাখোবাবু বড়সড় একটা পাথর গুলতিকে ভরে টিপ করতে লাগলেন। মনোজের ঠাকুমা যে নৈবেদ্য রেখে গেছেন কাকটা উঠোনে নেমে এসে তা খাচ্ছিল। মনোজ, সোজ আর পুতুল বাবার হাতের টিপ দেখবে বলে দম বন্ধ করে আছে।
সরোজ বলল, “বাবা ঠিক লাগাবে।”
মনোজ বলল, “পারবে না।”
পুতুল বলল, “তিন বারে পারবে।”
ঠিক এই সময়ে পেঁপে গাছের পিছনের দেয়াল টপকে একটা টুপিওলা মুখ উঁকি মারল।
সরোজ মনোজ একসঙ্গে চেঁচিয়ে বলল, “চাক্কুদা!”
রাখোবাবু কাকটাকে টিপ করতে করতে বিরক্ত হয়ে বললেন, “কাজের সময়ে বড় বিরক্ত করিস তোরা। আর এ কাকটাও অসম্ভব বজ্জাত। কিছুতেই এক জায়গায় স্থির হয়ে বসছে না।”
চাকু খুব ভাল ফুটবল ক্রিকেট খেলে, জুড়ো জানে, বকসিং করে। ব্যায়াম আর প্যাঁচ শিখতে সে রোজ লুকিয়ে লুকিয়ে ব্যায়ামবীর হারাধনের কাছে আসে। তাকে যে লুকিয়ে আসতে হয় তার কারণ চাকুর মামা গোয়েন্দা বরদাচরণের সঙ্গে মনোজের কাকা হারাধনের একেবারেই সদ্ভাব নেই। হারাধন আর বরদাচরণ কেউ কাউকে দেখতে পারেন না।
হারাধনের নাম শুনলে বরদাচরণ বলেন, “বৈজ্ঞানিক? হুঁ!”
আশ্চর্য এই, বরদাচরণের নাম শুনলে হারাধনও অবিকল একই সুরে বলেন, “গোয়েন্দা! হুঁঃ!”
বরদাচরণও কুস্তি, বকসিং, জুডো ইত্যাদি নাকি ভালই জানেন। তবে এসব ব্যাপারে বরদা আর হারার মধ্যে কে শ্রেষ্ঠ, তার কোনও মীমাংসা হয়নি।
চাকু দেয়ালের ওপর মুখ তুলে বাড়ির ভিতরটা ভাল করে দেখে নিয়ে মুখে আঙুল পুরে দুটো অদ্ভুত শিস দিল। শিসের শব্দ হতে-না-হতেই দেয়ালের ওপর বরদাচরণের মুখখানা ভেসে উঠল এবার। তিনিও বাড়ির ভিতরটা দেখতে লাগলেন।
সরোজ মনোজ ফের চেঁচাল, “গোয়েন্দাকাকু!”
রাখোবাবু মনোজ ফের চেঁচাল, “গোয়েন্দাকাকু!”
রাখোবাবু চাকু বা বরদাচরণকে লক্ষই করেননি। তিনি অতি নিবিষ্ট মনে গুলতির তাকের মধ্যে কাকটাকে আনবার চেষ্টা করছেন। কিন্তু নচ্ছার কাকটা কিছুতেই স্থির থাকছে না, কেবল লাফিয়ে-লাফিয়ে বেড়াচ্ছে। সরোজ-মনোজের চেঁচামেচি শুনে বিরক্ত রাখোবাবু বললেন, “আঃ, একটু চুপ করবি তোরা? কনসেনট্রেশন নষ্ট করে দিলে লোকে কী করে জরুরি কাজ করবে? যতক্ষণ কাকটার গায়ে না লাগছে ততক্ষণ আমি অফিস যাব না বলে মনে-মনে প্রতিজ্ঞা করেছি।”