কানাইয়ের মুখের চেহারা পালটে যায়। পনেরো টাকার মাছ সে তখন বারো টাকায় ছাড়তে রাজি। নিশিকান্তপুরের ডাকাতিটা নিয়ে হইচই করছে পুলিশ।
ওর মুখের চেহারা দেখে ভজবাবু বুঝতে পারলেন যে, কানাইকে এবার বাগে পাওয়া গেছে। জজ যখন আসামীর ফাঁসির হুকুম দেয়, তখন যেমন গম্ভীর করুণ মুখের ভাব করে, ঠিক তেমনি মুখ করে ভজবাবু কানাইয়ের দিকে চেয়ে আছেন। তা দেখে কানাইয়ের বুক কেঁপে ওঠে। সে ভয়ে-ভয়ে বলে, “দারোগাবাবু বোধহয় মাছের কথা ভুলেই গেছেন। আপনি যখন বলছেন–”
ভজবাবু ইঙ্গিতে রঘু দাঁড়িপাল্লা আর খুঁফো মিশির বাটখারা বের করে ফেলেছে। ঠিক এসময়ে একটা বাধা পড়ল।
হয়েছে কী, গোয়েন্দা বরদাচরণ আর তার অ্যাসিস্ট্যান্ট ভাগ্নে চাকুও বাজারে এসেছে। সবাই জানে, ভজবাবু বাজারে এলে সব জিনিস সস্তা হয়ে যায়। তাই ভজবাবুর পিছু পিছু বাজার করার জন্যে অনেকেই তক্কে তক্কে থাকে। যেই ভজবাবু আড়াই টাকার
মাল সাত সিকেতে কিনে নেন অমনি অন্য বাজাড়রা সেই দোকানিকে হেঁকে ধরে সব মাল সাত সিকে দিয়ে চিলু-চি করে কিনে নেয়। বরদাচরণও সেই দলের।
বরদাচরণ কইমাছ বড় ভালবাসেন। এবছর এখন পর্যন্ত কইমাছ খাওয়ার ভাগ্য তাঁর হয়নি। আজই প্রথম কানাই-মাছওলা কইমাছ নিয়ে বসেছে। অথচ বরদাবাবুর কিছু করারও নেই, কারণ বাজাড় ভজহরি মাছগুলিকে প্রায় গ্রেফতার করে ফেলেছেন।
তাই গোয়েন্দা বরদাচরণের মুখটা খুবই বিষণ্ণ হয়ে গেল।
ভাগ্নে চাকু ব্যাপারটা লক্ষ করে খানিক ভেবে নিয়ে মামার কানে কানে কী যেন একটু বুদ্ধি দিল। তখন মুখখানা উজ্জ্বল হয়ে উঠল বরদাচরণের।
তিনি কাঁচুমাচু মুখ করে ভজবাবুর কাছে গিয়ে খুব কুণ্ঠিত গলায় বললেন, “ভজহরিবাবু, একটু কথা ছিল।”
বাজার করার সময়ে ভজবাবু তৃতীয় পক্ষের সঙ্গে কথা বলতে ভালবাসেন না। ওস্তাদ কালোয়াত যেমন গানের সময়ে কেবল তবলচি বা তানপুরোওলা ছাড়া জগতের আর সব ভুলে যায়, ভজবাবুও বাজার করার সময়ে দোকানদার ছাড়া আর কাউকে মনে রাখতে চান না। বাজার করাটাও একটা আর্ট, আর আর্টের সময়ে কে ভ্যাজাল পছন্দ করে?
বিরক্ত ভজবাবু বলেন, “কথার আর সময় ছিল না? কইমাছগুলো, তুলছি, ঠিক এই সময়েই যত কথা!”
বরদাচরণ গম্ভীর হয়ে বললেন, “রাগ করবেন না ভজবাবু। আপনার বাড়িতে একটা অ্যাকসিডেন্ট হয়েছে।”
“অ্যাকসিডেন্ট!” ভজবাবুর হাত থেকে একটা মাছ লাফিয়ে পালিয়ে গেল। সেটাকে সাঁ করে ধরে ট্যাঁকে খুঁজে ফেলল কানাই। যা বাঁচানো যায়।
বরদাচরণ বিষণ্ণমুখে বললেন, “খুব খারাপ ধরনের অ্যাকসিডেন্ট। বাজারে আসবার পথে আপনার বাড়ির পাশ দিয়ে যখন আসছি তখন শুনি, ভিতরবাড়িতে তুমুল চেঁচামেচি হচ্ছে। বহু লোক ভিড় করেছে। আপনি একটু তাড়াতাড়ি চলে যান।”
ভজবাবু আর কইমাছের দিকে ফিরেও চাইলেন না। সর্বনাশ বলে চেঁচিয়ে উঠে বাড়িমুখো ছুটতে লাগলেন।
.
ভজবাবু বাড়ির কাছাকাছি যখন এসে পড়েছেন তখন শুতিধর ঘোষ আর ফচকে-ফটিকের সঙ্গে রাস্তায় দেখা। শ্রুতিবাবু একগাল হেসে ভজবাবুকে বললেন, “পড়ে গেছেন।”
হন্তদন্ত ভজবাবু আঁতকে উঠে বললেন, “মরে যায়নি তো?”
শুতিবাবু একটু চিন্তা করে বললেন, “না বোধহয়।”
তখন ভজবাবুর মাথায় আর-একটা প্রশ্ন এল, উদ্বিগ্ন হয়ে বললেন, “কে পড়েছে বলুন তো।”
“পিসিমা।”
খুব হতাশ হয়ে ভজবাবু বললেন, “ওঃ! তাই বলুন।”
শুতিবাবু খুব হেসেটেসে বললেন, “গণেশবাবু গরুর দড়ি চুরি করেছিলেন ফাঁসি যাওয়ার জন্য। ধরা পড়ে খুব নাকাল হচ্ছেন রাখোবাবুর কাছে। রাখোবাবু বলেছেন, এবার থেকে যেন গণেশবাবু ফাঁসি যাওয়ার জন্য নিয়মিত বাজার থেকে নতুন দড়ি আনিয়ে নেন।”
ভজবাবু বললেন, “আর কিছু হয়েছে?”
শুতিবাবু একটু চিন্তা করে বললেন, “হয়েছে। কিন্তু কী যেন! ফটিক, কী যেন..ইলেকট্রিক দিয়ে কী যেন হল…!”
ফটিক বলল, “পুরুতমশাই শক খেয়ে অজ্ঞান হয়ে পড়েছেন।”
“হ্যাঁ হ্যাঁ।” শুতিবাবু লাফিয়ে উঠে বললেন, “আর, দুঃখবাবুকে মনোজ ঠাকুরঝির ইংরিজি জিজ্ঞেস করেছিল, দুঃখবাবু পারেননি।”
“আর কিছু?”
“আরও চান?” শুতিবাবু ভারী অবাক হয়ে বলেন।
ফটিক বলে, “আরও একটা আছে।”
“কী যেন?” শুতিবাবু বলেন।
“সেই যে কাকটার কথা।” ফটিক মনে করিয়ে দিল।
“হ্যাঁ হ্যাঁ, একটা কাক।”
ভজবাবু আর দাঁড়ান না, দৌড়ে বাড়ির দিকে এগোতে থাকেন।
এদিকে ততক্ষণে ঠাকুরঝিকে গোবর থেকে তুলে স্নান করানো হয়েছে। সতীশ ভরদ্বাজ জ্ঞান হয়ে উঠে বসে গরম দুধ খাচ্ছেন। দুঃখবাবু তাঁর ঘরে বসে ডিকশনারি খুলে প্রাণপণ খুঁজে ‘ঠাকুরঝি শব্দের ইংরিজি খুঁজে পাচ্ছেন না। সরোজ একবার সিস্টার-ইন-ল বলায় ভারী রেগে গিয়েছিলেন তার ওপর। গণেশবাবু নিজের ঘরে শুয়ে কড়িকাঠের দিকে চেয়ে আছেন। রামু চশমা-চোখে হারিকেনকে খুঁজতে বেরিয়েছিল, খুব ঠাহর করে দেখে সে মাঠ থেকে হরশঙ্কর গয়লার একটা মোষকে ধরে এনে চুপিসাড়ে গোয়ালে বেঁধে রেখে এখন কদমগাছের তলায় বসে কাঁচা মুলো দিয়ে মুড়ি খাচ্ছে। রাখোবাবুর অফিস যাওয়ার সময় হয়েছে, কিন্তু হঠাৎ খেয়াল করে দেখেন, স্নানের আগে যখন গেঞ্জি ছেড়েছেন তখন সেই গেঞ্জির সঙ্গে গলার পৈতে খুলে গেছে। কিরমিরিয়া গেঞ্জি কেচে শুকোতে দেওয়ার সময়ে বাজে সুতো ভেবে সেটা কোথায় গুটলি পাকিয়ে ফেলে দিয়েছিল, বজ্জাত সেই কাকটা পৈতে মুখে নিয়ে পেঁপে গাছে গিয়ে বসে ছিল। এখন দেখা যাচ্ছে, পৈতেটা কাকের গলায় ঝুলছে। তাই দেখে মনোজের ঠাকুমা রেকাবিতে নৈবেদ্য সাজিয়ে পেঁপেতলায় রেখে প্রণাম করছেন। গলায় পৈতে না থাকায় রাখোবাবু কথা বলতে পারছেন না, কিন্তু বারান্দায় দাঁড়িয়ে নিঃশব্দে মুখ নেড়ে ভয়ংকর রাগারাগি করছেন, আর হাত-পা ছুড়ছেন। মুখের নানারকম ভঙ্গিতে কখনও ‘গাধা’ কখনও ‘গরু’, কখনও ‘বোকা’ শব্দগুলি বুঝিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করছেন তিনি।