ভজবাবুর বাজার করার কায়দা একটু অন্যরকম। সে কায়দাটা এমনই অদ্ভুত যে অন্য খদ্দেররা নিজেদের বাজার করা বন্ধ রেখে ভজবাজাড়র বাজার করা হাঁ করে দেখে।
যেমন আজ টমেটোওলা ভজবাবুকে দেখে খুব বিনয়ী হাসি হেসে এক গালের পান অন্য গালে নিয়ে আড়াই টাকার টমেটোর দাম ন সিকে চেয়ে বলল, “আপনি বলেই চার আনা ছেড়ে দিলাম।”
ভজবাবু নির্নিমেষলোচনে টমেটোওলার দিকে খানিকক্ষণ চেয়ে রইলেন। পাড়ার থিয়েটারে কেপুবাবু সিরাজদ্দৌলা সেজে মহম্মদী বেগ-এর হাতে ছোরা খেয়ে যেমনভাবে চেয়েছিলেন (সে-দৃশ্যে যে হাততালি পড়েছিল তা দু মাইল দূর থেকে শোনা যায়) ঠিক তেমনি চোখের দৃষ্টি ভজবাবুর। সেই চোখ দেখে টমেটোওলার রক্ত জল হয়ে যেতে লাগল। মিনমিন করে সে আরও দু আনা ছেড়ে বলল, “ঠিক আছে ভজবাবু, না হয় দু আনা কম দেবেন।”
ভজবাবু সে কথার উত্তর দিলেন না। তাঁর থমথমে মুখচোখ ক্রমে লাল হয়ে উঠেছিল। চোখ দুটো স্থির, নাকের পাটা কাঁপছে। এক পাশে বেগুন দর করতে করতে, অন্য পাশে পালং শাক থলিতে ভরতে ভরতে দুজন-চারজন করে লোক এগিয়ে এসে আশেপাশে দাঁড়িয়ে গেল। ভজবাবুর পার্ট দেখবে।
ভজবাবুর ঠোঁট কেঁপে উঠল, ফিসফিস করে প্রথমে বললেন, “মহাপাপ।”
কথা শোনার জন্য দু-চারজন কান এগিয়ে আনল। ভজবাবু এবার আর-একটু জোরে বলে উঠলেন, “মহাপাপ!” সেই গম্ভীর ধ্বনি শুনে টমেটোওলার মুখ শুকিয়ে গেল।
পরক্ষণেই ভজবাবু হঠাৎ দু হাত লাফিয়ে উঠে বিকট হুংকার ছাড়লেন, “মহাপাপ! মহাপাপ! মহাপাপ!”
যারা কান এগিয়ে এনেছিল, তারা এই বিকট শব্দে কান চেপে ধরে পাঁচ হাত করে পিছিয়ে গেল।
ভজবাবু লাফাচ্ছেন আর হুংকার দিচ্ছেন, “মহাপাপ! পৃথিবী রসাতলে যাবে।”
তারপর টমেটোওলার দিকে আঙুল তুলে চেঁচাতে লাগলেন, “তুইও রসাতলে যাবি। এখনও সময় আছে, বল ঠিক করে।”
টমেটোওলা নিথর হয়ে বসে রইল খানিকক্ষণ। তারপর হঠাৎ চোখে মুছে ধরা গলায় বলল, “সাত সিকে। দিন বাবু, আপনার দাঁড়িপাল্লা দিন।”
ভজবাবু সব জায়গায় এক কায়দা খাটান না। তা হলে আর বাজাড় হিসেবে তাঁর অত নাম-ডাক কিসের?
টমেটোওলাকে কাঁদিয়ে তিনি পালং শাক বেচতে-আসা একটা ছোট মেয়ের ঝুড়ির সামনে এসে দাঁড়ালেন। মেয়েটার বয়স দশ বছর হবে। পান-খাওয়া রাঙা ঠোঁট চেপে খুব গম্ভীরমুখে নাকে নোলক দুলিয়ে বসে ছিল।
ভজবাবু তার সামনে উবু হয়ে বসে মুখের দিকে চেয়ে ভারী মোলায়েম হেসে ছড়া কাটার মতো সুর করে বলতে লাগলেন, “ও খুকি, তুমি পান খেয়েস? বাঃ বাঃ, পান খেয়েস! নাকে নোলক মুখে পান, জয় জয় বলল জয় ভগবান।”
মেয়েটা ভয় পেয়ে খুব সন্দেহের চোখে ভজবাবুকে দেখতে থাকে।
ভজবাবু মাথা নেড়ে নেড়ে বলেন, “খুকি নোলক পরেসে, খুকি পান খেয়েসে। খুকি নোক পরেসে, খুকি পান খেয়েসে। পালং শাক কত করে গো খুকি?”
মেয়েটা মুখ ঝামটা দিয়ে বলল, “টাকা টাকা।”
ভজবাবু মুখখানা ভার করে বললেন, “পান খাওয়ার কথায় রাগ করলে খুকুমোনা? এমাঃ, রাগ করলে! পালং কখনও এক টাকা হয়?”
মেয়েটা কাঁদো কাঁদো হয়ে বলে, “বাবা বলে গেছে, এক টাকার কমে কাউকে বেচবি না।”
ভজবাবুর দুচোখ বেয়ে টপটপ করে জল পড়তে লাগল। হাপুস চোখে কেঁদে ভজবাবু বললেন, “ও খুকি, তুই আমার ওপর
রাগ করলি শেষে। পান খাওয়ার কথা বললাম বলে রাগ করলি?”
কান্নাকাটি দেখে ছোট মেয়েটা ঘাবড়ে গিয়ে দিশেহারার মতো বলে ফেলে, তা আমি কী করব? বাবা বলে গেল যে।”
ভজবাবু চোখ মুছে ধরা-গলায় বলেন, “তুই বুঝি বাপের সব কথা শুনিস খুকি? চুরি করে তেঁতুল খাস না? নতুন জামার জন্য বায়না করিস না? কাজের সময়ে পালিয়ে খেলতে যাস না?”
মেয়েটা ফিরিক করে হেসে বলল, “আচ্ছা, বারো আনা করে দাও।”
মেছোবাজারের কানাই মাছওলা বড় ভয়ংকর লোক। সবাই জানে, কানাই দিনে মাছ বেচে, রাতে ডাকাতি করে। গুলিপাকানো বিশাল চেহারা তার, চোখ দুখানা সবসময়ে গাঁজাখোরের মতো লাল, খদ্দেরদের সঙ্গে ধমকধামক দিয়ে কথা বলে। আধমন একমন ওজনের বড় বড় মাছ হেলাফেলায় তুলে ভচাং ভচাং করে কেটে ফেলে লহমায়। বুকের পাটা না থাকলে কেউ কানাইয়ের সঙ্গে দরাদরি করতে যায় না।
কানাইয়ের দোকানে আজ মস্ত মস্ত কইমাছ। দূর থেকে ভজবাজাড়কে দেখেই কানাই তড়িঘড়ি কইমাছগুলোকে গামছা-চাপা দিয়ে রাখল। পনেরো টাকা দর দিয়ে রেখেছে, ভজবাবু দেখলেই দশ টাকায় নামিয়ে ফেলবে। তার চেয়ে চেপে রাখা ভাল।
কিন্তু কইমাছ চাপা কি সোজা! তারা লাফায়, হাঁটে, ছোটে। গামছায় চাপা কইমাছেরা গামছাটা ছেঁড়ার জোগাড় করে তুলল।
ভজবাবু এসে গম্ভীরমুখে বললেন, “গামছাটা কত দিয়ে কিনেছিলি?”
কানাই মাথা চুলকে বলে, “কত আর! তিন টাকা বোধ হয়।”
ভজবাবু তেমনি গম্ভীর মুখে বলেন, “মাছের দামের সঙ্গে গামছার দামটা যোগ করে বল কইমাছের দর কত।”
কানাই মুখখানা কাঁচুমাচু করে বলল, “ও মাছ বিক্রি হয়ে গেছে, তাই ঢেকে রেখেছি।”
“কে কিনেছে?” কানাই অন্যদিকে চেয়ে বলল, “দারোগাবাবু।”
এ সব চালাকি ভজবাবু জানেন, তাই একটুও না ঘাবড়ে বললেন, “আমি তো থানার কাছ দিয়েই যাব। মাছগুলো দিয়ে দে বরং, পৌঁছে দিয়ে যাবোখন। দারোগাবাবু আবার নিশিকান্তপুরের ডাকাতির ব্যাপারে আমার পরামর্শ চেয়েছিলেন।”