কিন্তু সেকথায় কেউ কান দিচ্ছে না।
দুঃখবাবু আর গণেশবাবু এসে গোয়ালঘরে ঢুকে চুপচাপ দাঁড়িয়ে রয়েছেন। গণেশবাবুর চাঁদরের তলায় গরুর দড়িটা সুকোনো আছে, কিন্তু সেটা বের করতে সাহস হচ্ছে না।
মনোজ দুঃখবাবুকে জিজ্ঞেস করল, “মাস্টারমশাই গোবরের ইংরিজি কী?”
“কাউডাংগ।”
“আর পিসিমা হল আন্ট, না?”
“হ্যাঁ।”
“তা হলে গোবরে পিসিমা কেন, এর ইংরিজি হবে হোয়াই আন্ট ইজ ইন কাউডাংগ, না মাস্টারমশাই?”
“হুঁ।”
“ল্যাজে গোবরের ইংরিজি কী হবে মাস্টারমশাই?”
দুঃখবাবু বলতে পারলেন না। সন্তর্পণে একবার রাখোবাবুর দিকে তাকালেন। রাখোবাবু ভ্রূ কুঁচকে দুঃখবাবুর দিকেই চেয়ে ছিলেন। বললেন, “এরকম ছোটখাটো সব ঘটনার ভিতর দিয়ে শেখালে ছেলেদের শিক্ষা ভাল হয়। ল্যাজে গোবরের ইংরিজিটা ওকে শিখিয়ে দিন দুঃখবাবু।”
দুঃখবাবু দুঃখের সঙ্গে মাথা চুলকোলেন। বললেন, “টেইল ইন কাউডাংগ। অ্যান্ড কাউডাংগ ইন টেইল।”
২. সারা উঠোনে ডালবাটা
সারা উঠোনে ডালবাটা ছত্রখান হয়েছিল। এখানে সেখানে ডালবাটায় কাকের পায়ের ছাপ। এতক্ষণ সারা উঠোনে হুটোপাটা করে কাকটা পেঁপে গাছে বসে ঠোঁট দিয়ে তার গা পরিষ্কার করছিল।
বামাসুন্দরী হাতজোড় করে কাকটাকে প্রণাম করে বললেন, “যাই, ঠাকুলুঝি আজ আবার কী কাণ্ড বাধালে দেখে আসি। আছাড় খেতে পারেও বটে মানুষটা, আমাদের এত বয়স হল, এখনও তো অত আছাড় খেতে পারি না।”
সতীশ ভরদ্বাজ গম্ভীরভাবে বারান্দার চেয়ারে বসে পুজোর চালকলার পেতলের রেকাবিখানা টেবিলের ওপর রেখে খবরের কাগজটা পড়ছিলেন। তারপর শব্দ করে খবরের কাগজ পড়তে লাগলেন, “জিনিসপত্রের দাম ক্রমশই বৃদ্ধি পাইতেছে। এইরূপ বৃদ্ধি পাইলে গরিব মনুষ্যেরা কী করিয়া প্রাণধারণ করিবে, কাহার কাছে হাত পাতিবে? হ্যাঁ, ঠিকই তো, ইয়ার্কি পেয়েছ নাকি? ইহারা কী করিয়া ইয়ে করিবে?”
ঠাকুরমশাই একটু অন্যরকম করে কাগজ পড়েন। বেশ বসে জোরে জোরে খবর পড়ছেন, পড়তে পড়তে উত্তেজিত হয়ে তার ভিতরেই নানারকম মন্তব্য করতে থাকেন। শুনলে মনে হয় যেন ওসব কথাও কাগজে ছাপা আছে।
যেমন তিনি এখন পড়ছেন, “কালিচরণ সাধুকে পুলিশ দায়রায় সোপর্দ করিয়াছে। সে নাকি পঞ্চবর্ষীয়া এক বালিকার কান হইতে দুল ছিনাইয়া লইয়া…ইস, ছিঃ ছিঃ-বালিকাটির কান কাটিয়া প্রবল রক্তপাত হইতে থাকে…চামারটাকে জুতোপেটা করতে হয়।…দুই দলের খেলায় কেহই গোল করিতে পারে নাই–তা পারবে কেন, অপদার্থ সব। সিমলায় প্রচণ্ড তুষারপাত…উঃ ঊঃ ইঃ ইঃ, বরফ বড় ঠাণ্ডা রে বাপ! মুরগিহাটায় জোড়া খুন…ছুরিকাঘাতে..বাবারে, ছুরি যখন কচ্ করে শরীরে ঢোকে তখন না জানি কেমন লাগে!”
ঠিক এসময়ে ঝপাত করে কাকটা নেমে এল বারান্দার রেলিঙে। বসে ডাকল, কা?
ঠাকুরমশাই কাগজটা নামিয়ে ডবল পাওয়ারের চশমার ওপরের অংশটা দিয়ে কাকটাকে দেখে বললেন, “কা তব কাস্তা কন্তে পুত্রঃ? তোমার স্ত্রীই বা কোথায় ছেলেপুলেই বা কোথায়? পশুপাখির আত্মীয়স্বজন থাকে না। বড় হতভাগ্য হে তোমরা।” বলে খবরের কাগজটা ফের তুলে নিয়ে পড়তে লাগলেন “বর্ধমানে বড় কাকের উৎপাত বাড়িয়াছে। এই কাকগুলি কিছু অন্যরকম। সাধারণ কাক নয়। গৃহস্থের বাড়িতে ঢুকিয়া ইহারা দিনে ডাকাতি করিতেছে…”
কাকটা ডাকল, ক্কঃ।
ঠাকুরমশাই ফের কাকটার দিকে চেয়ে বললেন, “কং? কে। তুমি? কোত্থেকে আসছ? বর্ধমান নয় তো? তোমার ভাব সাব ভাল ঠেকছে না হে! গচ্ছ, গচ্ছ।”
কাকটা একটু কাসির শব্দ করে বলল, “ক্যায়াও?”
“ঝোলালে। ক্যায়াওটা আবার কী?”
কাকটা এক লাফে টেবিলের ওপর চলে এল। তারপর চোখের সামনে, হাতের নাগালে বসে টাউ-টাউ করে চালকলা খেতে লাগল।
ঠাকুরশাই তেড়ে গিয়ে বললেন, “হুঁশ।”
কাকটাও চাল ঠুকরে দিতে এসে বলল, কবয়ঃ।”
সতীশ ভরদ্বাজ পিছিয়ে এলেন।
“কবয়ঃ?” ঠাকুরমশাই বললেন, “এ তো বিশুদ্ধ সংস্কৃত!”
“কয়।” কাকটা বলল।
ঠাকুরশাইয়ের হাত থেকে কাগজটা খসে পড়ে গেল। হঠাৎ তিনি বুঝতে পারলেন, এতক্ষণে ধরে যা হচ্ছে তা খুব সাধারণ ঘটনা নয়। বামাসুন্দরীকে ভয় খাওয়ানোর জন্য যা বানিয়ে বলেছিলেন তাই বুঝি সত্যি হল! তিনি হঠাৎ হাউ মাউ করে দৌড়ে গিয়ে উঠোনের ওপাশে বৈজ্ঞানিক হারাধনের ল্যাবরেটরিতে ঢুকে টেবিলের ওপর হুমড়ি খেয়ে পড়লেন। সেখানে একটা উপুড় করা গামলার মতো কী-এক যন্ত্র, সেটা ছোঁয়ামাত্র ঠাকুরমশাইয়ের গা কাঁটা দিয়ে উঠল, মাথার চুল এমন কী টিকিটা পর্যন্ত দাঁড়িয়ে গেল। শরীরে একটা শিরশির ভাব।
টেবিলের ওপাশ থেকে হারাধন গম্ভীরভাবে বলল, “সাকসেসফুল।”
“কী বাবা, কী সাকসেসফুল?”
“স্ট্যাটিক ইলেকট্রিসিটি। এতক্ষণ এটা নিয়ে এক্সপেরিমেন্ট করছিলাম।”
মনোজের মেজকাকা ভজহরি বাজার করার ব্যাপারে খুব পাকা লোক। সবাই বলে, ভজবাবুর মতো বাজাড় দুনিয়ায় দুটো নেই। বাজারের যত ব্যাপারী আর দোকানদার বাজাড় ভজহরিকে দেখলেই ভয় খায়। যে তে-এঁটে সবজিওলা সকাল থেকে ফুলকপির দর দেড় টাকার এক পয়সা নীচে নামায়নি, সে পর্যন্ত বাজাড় ভজবাবুকে দেখলে নাভাস হয়ে নিজে থেকেই ‘পাঁচসিকে’ বলে ফেলে। যে-সব দোকানদার গোলমেলে দাঁড়িপাল্লা বা বাটখারা দিয়ে ওজন করে, তারা ভজবাজাড়র গন্ধ পেলেই সব সরিয়ে ফেলে ভালমানুষ সাজে। অবশ্য ভজবাবু কখনও দোকানদারের দাঁড়িপাল্লা বা বাটখারায় মেপে জিনিস কেনেন না, তাঁর সঙ্গে সবসময়ে নিজস্ব দাঁড়িপাল্লা এবং বাটখারা থাকে। রান্নার ঠাকুর গুফো মিশির আর চাকর রঘু সেসব বাজারে বয়ে নিয়ে যায়।