আদ্যশক্তিদেবী আছাড় খেয়েছেন শুনলে কেউ আজকাল আর অবাক হয় না। কেউ যদি কাউকে গিয়ে বলে, জানো, আদ্যাশক্তি দেবী আছাড় খেয়েছেন? তা হলে যাকে বলা হয় সে একটু অবাক হয়ে বলবে, হ্যাঁ, সে আর বলার কী? উনি তো প্রায়ই তো খেয়ে থাকেন। ওটাই ওঁর অভ্যাস, নেশা।
তবু কেউ যদি আছাড় খায়ই, সে আদশ্যক্তি দেবীই হোন বা আর যে কেউ হোক, নিয়ম হল লোজন গিয়ে তাকে ধরাধরি করে তুলবে। গোয়ালঘরের চেঁচামেচি শুনে তাই সবাই দৌড়ে গেল।
গিয়ে দেখে, গোয়ালঘরের এক কোণে যেখানে মনোজের কাকা বৈজ্ঞানিক এবং ব্যায়ামবীর হারাধন গোবর গ্যাস তৈরি করার জন্য বিশাল এক গর্তে গোবরের তাল জমিয়ে রেখে পচাচ্ছিল সেখানে আদ্যাশক্তিদেবীর অর্ধেক ডুবে আছে। তিনি নিঃশব্দে চেঁচাচ্ছেন। অর্থাৎ তাঁর মুখ নড়ছে, কিন্তু শব্দ বেরোচ্ছে না।
রাখোবাবু গম্ভীর মুখে বললেন, “এ নিশ্চয়ই হারিকেনের কাজ।”
বুড়ি ঝি কিরমিরিয়ার অভ্যাস হল, বাড়িতে কোনওরকম ঘটনা ঘটলেই সে বিলাপ করে কাঁদতে বসবে। রাখোবাবু যদি মনোজকে বকেন তো কিরমিরিয়া কাঁদতে বসে। পুতুলের ড্রইং-এর খাতা হারালেও কারও কিছু নয়, কিরমিরিয়া বিলাপ করতে বসল–ও বাবাগো, খখাঁকির খাতাটা কোথায় গেল গো? খোঁকির এখন কী হবে গো! ইস্কুলের দিদিমণি এখন খোঁকিকে বকবে গো! সারাদিন তার বিলাপের জ্বালায় সবাই অস্থির। এখন বাড়িতে যাই ঘটুক, কিরমিরিয়াকে কেউ কিছু খবর দেয় না।
প্রায় দুদিন কিরমিরিয়া বিলাপ করেনি। বিলাপ না করলে তার পেট ফেঁপে যায়, খিদে নষ্ট হয়ে মুখে অরুচি হয়। রোগাও হয়ে যায় সে। দুদিন বাদে আজ জবর ঘটনা দেখে কিরমিরিয়া গিয়ে গোবরে অর্ধেক ডুবে-থাকা আদ্যাশক্তি দেবীর মুখের সামনে উবু হয়ে বসে মনের সুখে কেঁদেকেটে বিলাপ করতে লাগল, “ও ঠাকুরঝি গো, এত জায়গা থাকতে তুমি কেন গোবরে গিয়ে পড়লে গো! উঠোনে পড়লে না, পুকুরে পড়লে না, ছাদ থেকে পড়লে, গোবরে গিয়ে পড়লে গো! এখন তোমারই বা কী হবে, গোবরেই বা কী হবে গো?”
খবর পেয়ে পাড়ার লোকজনও সব এসে জুটেছে। তাদের মধ্যে একজন হচ্ছে শ্রুতিধর ঘোষ। শ্রুতিবাবুর এক অভ্যাস, কিছু দেখলে বা শুনলে তাঁর আর-একটা কিছু মনে পড়ে যায়। কিন্তু ঠিক মনে পড়ে বলেও বলা যায় না। কী যেন একটা মনে আসি-আসি করে, কিন্তু আসে না। যেমন একবার দুঃখবাবুর পেটের ব্যথা হওয়ায় তিনি এসে বললেন, “পেটের ব্যথার তিনটে খুব ভাল ওষুধ আমি জানি।”
“কী বলুন তো!” দুঃখবাবু খুব উৎসাহের সঙ্গে বলেন।
তখন অনেকক্ষণ চিন্তা করে শুতিবাবু বললেন, “একটা হল গিয়ে ইয়ে, মানে ওই আর কী!”
রাখোবাবু পাশেই ছিলেন, বললেন, “আর দুটো?”
শুতিবাবু আবার চিন্তা করে বললেন, “আর একটা যেন কী! আর তৃতীয় ওষুধটার নাম ভুলে গেছি।”
তবু সবসময়েই শুতিবাবুর কী যেন মনে-পড়ি-পড়ি করে, এই যেন এক্ষুনি মনে পড়ে যাবে, প্রায় এসে গেছে মাথায়।
সেই শুতিবাবু আদ্যাশক্তির অবস্থা দেখে বললেন, “গোবরে..গোবরে…কী যেন?”
তার ভাইপো ফচকে ফটিক বলল, “গোবরে পদ্মফুল?”
“না, না। গোবরে আর একটা কী যেন!”
“গুবরে পোকা।”
“দুর ফাজিল।” সুতিবাবু রেগে যান। তারপর রাখোবাবুর দিকে চেয়ে বলেন, “ব্যাপারটা কী হল মশাই? গোবরে পিসিমা কেন?”
রাখোবাবু খুব ভেবেচিন্তে বলেন, “আমরাও তাই ভেবে মরছি। তবে মনে হয় এটা হারিকেনের কাজ।”
“হারিকেন!” বলতে গিয়েই শুতিবাবুর আবার কী যেন মনে আসি-আসি করে। ভাবতে ভাবতে বলেন, “হারি,হারি! হারি আপ কী-একটা কথা আছে না? তার মানে বলতে চাইছেন, হারি মানে তাড়াহুড়ো করতে গিয়ে পিসিমার এই দশা! এখন প্রশ্ন হল কেন, কেন এই হারি! হারি কেন? তাই না?”
রাখোবাবু বিরক্ত হয়ে বলেন, “মোটই না। আমাদের বদমাশ গরুটার নাম হারিকেন। হারিকেন হচ্ছে একরকমের সামুদ্রিক ঝড়। ও বাচ্চা ছেলেও জানে। আমাদের গরুটা ঝড়ের মতো দৌড়য়, অঁতোয়, বেড়া ভাঙে, গাছ ওপড়ায় বলে ওর ওই নাম রাখা হয়েছে। মনে হচ্ছে সেই গরুটাই পিসিমাকে গুঁতিয়ে নিয়ে গোবরে ফেলেছে। কিন্তু গরুটা তো বেশ ভাল করে বাঁধা ছিল, একটু বাদে তাকে মাঠে নিয়ে গিয়ে রঘু খোঁটা পুঁতে দিয়ে আসবে কথা ছিল। সেটা ছাড়া পেল কীভাবে?”
এক গাল হেসে শুতিবাবু বললেন, “ওই হল। হারিকেনের গুঁতোর ভয়ে হারি করতে গিয়ে তাড়াতাড়ি পিসিমা গোবরে পড়েছেন। কিন্তু গোবর নিয়ে কী একটা কথা আছে, কিছুতেই মনে পড়ছে না।”
এই বলে শুতিবাবু ভাবেন। ফটিক বলে, “যাঁড়ের গোবর।”
“দূর।“
“মাথায় গোবর।” ফটিক ফের বলে।
শ্রুতিবাবু তার দিকে কটমট করে তাকান।
ফটিক ফচকে হেসে বলে, “পালোয়ান গোবরবাবু?”
কিরমিরিয়া একটু কান্না থামিয়ে কথাবার্তা শুনে নিয়ে ফের ডুকরে ওঠে, “ও বাবা গো, হারিকেনটাই বা কোথায় গেল গো! সে যে এখনও ভাল করে সকালের জাবনা খায়নি গো! সে যে না খেয়ে খেয়ে ল্যাজে গোবরে হয়ে যাবে গো!”
“ওই!” শ্রুতিবাবু চেঁচিয়ে উঠে বললেন, “ওই মনে পড়েছে। ল্যাজে গোবরে! হেঃ হেঃ, এ যে দেখছি পিসিমার একেবারে ল্যাজে গোবরে অবস্থা!”
আদ্যাশক্তিদেবী বুক সমান গোবরের গর্তের মধ্যে পোঁতা। ঘন গোবরের টালের ভিতর থেকে নিজে নিজে বেরিয়ে আসবেন সে সাধ্য নেই। ঘন মধুর মধ্যে পড়লে মাছি যেমন আটকে যায়, তাঁর অনেকটা সেই দশা। অনেকক্ষণ চেঁচামেচি করায় গলা বসে গেছে, বাক্য বেরোচ্ছে না। তিনি দুহাত বাড়ির সবাইকে বলতে চাইছেন, “ওরে তোরা আমাকে টেনে তোল।”