“দেবেন। খুঁটে আমরা নিই না। আমরা টাকা সোনা আর দামী জিনিস নেব। আপনারা ঘর ছেড়ে দিন। এখন মেলা কাজ আছে আমাদের। চোর কুঠুরির গুপ্ত দরজা খুঁজে বের করতে হবে।”
রানীমা শ্বাস ফেলে বললেন, “সে আর খুঁজতে হবে না বাছা, পূর্ব-দক্ষিণ কোণের ওই খাটটা সরালেই দেখতে পাবে। চোরকুইরির দরজা খোলাই আছে। কিন্তু নেওয়ার কিছু নেই। লাখ লাখ অচল টাকা। যাও নিজেরাই দেখে এসো গে।”
“অচল টাকা?” মেজ-সর্দারের মুখটা খানিকক্ষণ থমথম করে। কী একটু ভাবে সে। তারপর মাথা নেড়ে বলে, “তাই বটে। অচলই হওয়ার কথা। আমি ছেলেবেলায় দেখেছি ওসব টাকা বহুঁকালের পুরনো। তখনই বোধ হয় বাজারে চলত না। এখন তো আরও চলবে না।”
রানী-মা ভ্রু কুঁচকে বলেন, “ছেলেবেলায় দেখেছ মানে? তুমি কি বাবা এবাড়িতে এসেছ কখনও?”
“মনে হয় যেন এসেছি। সবই চেনা লাগছে।”
রানী-মা উদ্বেল হয়ে বললেন, “তুমি একটু কাছে এসো তো বাবা, তোমার মুখোনা একটু ভাল করে দেখি। ও আমার ডাকাত-ছেলেরা, তোমরা একটু মশালগুলো ভাল করে ধরো তো।”
রাজা গোবিন্দনারায়ণের মূর্ছা হঠাৎ ভাঙল। কারণ, কে যেন তাঁর ঘাড়ে আর মুখে সুড়সুড়ি দিচ্ছিল। মূর্ছা ভেঙে তিনি হাই তুলে পিছু ফিরতেই আবার মূর্ছা গেলেন। এবং দাঁড়িয়ে। তামর কারণ হারাধনের কিম্ভুত এবং অতিকায় গোরিমানটা গোবিন্দনারায়ণকে খুঁকে দেখছিল।
গোবিন্দনারায়ণকে ও রকম স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে গোরিমানটা বিরক্ত হয়ে তাঁকে ছেড়ে ভিতরবাগে চলল। একটা ছ্যাঁচড়া ডাকাত টুলের ওপর উঠে রাজবাড়ির একটা দেয়াল থেকে পুরনো একটা দেয়ালঘড়ি খুলে নেওয়ার চেষ্টা করছিল। গোরিমানটা পিছন থেকে গিয়ে টুলটা ধরে অল্প অল্প ঝাঁকাতে লাগল। ডাকাতটা পিছু না ফিরেই বলল, “ঝাঁকাস না বাপ! ঘড়িটা বেচে যা পাব তা দু-জনের ভাগ।”
গোরিমানটা আরও জোরে ঝাঁকায়। ডাকাতটা পেল্লায় একটা ধমক দিয়ে ভাল করে না-দেখেই পিছনে একটা লাথি চালিয়ে দিল। সে ভেবেছিল তার স্যাঙাতদেরই কেউ হবে।
গোরিমান লাথি খেতে পছন্দ করে না। তাই সে খুব গম্ভীরভাবে টুলটা টেনে দূরে ছুঁড়ে ফেলে দিল। ডাকাতটা মাটিতে পড়ে পেল্লায় চেঁচাতে থাকে। বিরক্ত গোরিমান তাকে তুলে বগলে থার্মোমিটারের মতো চেপে ধরে চারদিকে ঘুরে দেখতে লাগল।
রাজবাড়ির ফটকে ততক্ষণে পুলিশের গাড়িটাড়ি সব এসে পৌঁছেছে। একটা জিপগাড়ি থেকে অতি সাবধানে নামতে নামতে নিশি দারোগা বললেন, “কালী, কালী! ওরে, তোরা সব সাবধানে চারদিক দেখে-টেখে এগো। আমার আজ শরীরটা ভাল নেই। বড্ড হাই উঠছে।”
সন্ধেবেলা গোরিমানগুলোর হাতে নাকাল হয়ে সেপাইরাও একটু ঠাণ্ডা মেরে গেছে। বন্দুক বা লাঠি হাতে থাকলেও তারা খুব সাহস পাচ্ছে না। একজন সেপাই বলে উঠল, “বড়বাবু, আপনার শরীর খারাপ হলে আমারও খারাপ। পেটটা তখন থেকে বকম বকম করছে।”
আর একজন সেপাই বলে দিল, “আমরা যখন জাম্বুবানের হাতে ধোলাই খেলাম, তখন আপনি বাইরে দাঁড়িয়ে গল্প করছিলেন বড়বাবু। এবার না জানি আবার কার পাল্লায় পড়ি, এবার দয়া করে আপনি আমাদের সঙ্গে-সঙ্গে থাকুন।”
নিশি দারোগা বললেন, “কালী কালী। চল দেখি।”
বলে খুব অনিচ্ছেয় তিনি টর্চ আর রিভলবার বাগিয়ে সাবধানে রাজবাড়ির ফটক পার হয়ে ঢুকলেন।
ওদিকে রানী-মা চার-পাঁচটা মশাল আর সেজবাতির আলোয় মেজ-সর্দারের মুখ দেখছেন। আর মেজ-সদার, যার ভয়ে গোটা গঞ্জ কাঁপে, ডাকাতরাও যাকে যমের মতো ডরায়, সেই মহাতেজী মেজ-সদার রানী-মার খাটের পাশে মেঝেয় হাঁটু গেড়ে বসে খুব লজ্জা লজ্জা ভাব করে রানী-মাকে নিজের মুখ দেখতে দিচ্ছে।
এসব ব্যাপারে অধৈর্য হয়ে বিড়ি-চোর চোর কুঠুরিতে যাবে বলে খাটের নীচে হামাগুড়ি দিয়ে ঢুকেছিল, কানাই তার ঠ্যাং ধরে টেনে এনে খুব ঘাতক দিয়ে বলল, “সদারের হুকুম হয়নি, তার আগেই ঢুকছিলি যে বড়? দেব গদান নামিয়ে?”
বিড়ি-চোরও তেড়িয়া হয়ে বলে, “আমিও গদান নামাতে জানি।”
দুজনে তুমুল ঝগড়া লেগে পড়ল।
সে গোলমালে অবশ্য রানী-মা বা মেজ-সদারের কান নেই। রানী-মা ডাকাতের সদারের মাথায় হাত বুলোতেবুলোতে বললেন, “ভাবতেও ভয় করে, যদি সত্যি না হয়। কিন্তু বাবা, তুমি যদি আমার হারানো ছেলে কন্দর্পনারায়ণ হতে।”
রাজমাতাও বললেন, “আহা, যদি আমার নাতি কন্দু এখন ফিরে আসত।”
ঠিক এই সময়ে পিস্তল হাতে হারাধন, খাঁড়া হাতে গোয়েন্দা বরদাচরণ এবং ছবি হাতে মনোজ ঘরে এসে ঢুকল।
বরদাচরণ মননজের হাত থেকে ছোঁ মেরে ছবিটা কেড়ে নিয়ে
হাঃ হাঃ অট্টহাসি হেসে বললেন, “মহারানী, হওয়া-হওয়ির কথা আর বলবেন না। আপনার সামনে ওই যে ডাকাত দলের সদার বসে আছে, সে-ই হল আপনার হারানো ছেলে কুমার কন্দর্পনারায়ণ। আগে দেখুন এই ছবিটা কুমার কন্দর্পের ছবি কিনা।”
রানী-মা বরদাচরণের মতোই হুবহু ছোঁ মেরে ছবিটা কেড়ে নিয়ে দেখেই বলে উঠলেন, “বলো কী বাবা গোয়েন্দা! এই তো আমার কন্দর্পর ছবি! সেবার আমরা দেওঘরে বেড়াতে গিয়েছিলাম। কন্দর্প দুধের গেলাশ পাশে রেখে ছবি তুলতে বসেছিল, পিছনের ঘরে পর্দার আড়ালে আমি দাঁড়িয়ে দেখছি। হতচ্ছাড়া বেড়ালটা তখন কোত্থেকে এসে দুধটা খেয়ে যাচ্ছিল…হুবহু সব মনে পড়ে যাচ্ছে যে!”