অন্য সব ডাকাতরা যে যার নিজের কাজে ব্যস্ত। একটা লোভী ডাকাত রান্নাঘরে ঢুকে জলে ভেজানো ভাত খেতে ব্যস্ত। একজন বাসনকোসন বস্তায় ভরছে। আর-একজন রাজবাড়ির যত জামাকাপড় সরাচ্ছে। চারদিকেই খুব হাল্লা-চিল্লা।
বিড়ি-চোর বলল, “মেজ-সদারের ডাকাতির দিকে মন নেই।” কানাই দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলে, “বড়সদারও তাই বলে।”
“কী বলে?”
“বলে, মেজটা ভদ্রঘরে জন্মেছিল। তারপর আট-দশ বছর বয়সে বাড়ি থেকে ভেঙ্গে পড়ে। হরিণগড় রেলস্টেশনে গাড়িতে উঠতে গিয়ে পড়ে মাথা ফেটে যায়। সেই থেকে হারানো কথা মনে করতে পারে না। তবে সেই গাড়িতে বড় সদার কাশী যাচ্ছিল তীর্থ করতে। মেজ-সদার কোন্ বাড়ির ছেলে তা সে বুঝতে পেরেছিল। সে-ই টেনে ট্রেনের মধ্যে ছেলেটাকে তুলে নেয়। মাথায় মতলব ছিল যে, ছেলেটাকে লুকিয়ে রেখে তার বাপের কাছ থেকে মোটা টাকা আদায় করবে। কিন্তু সে আর হয়নি। বড় সর্দারের বউয়ের ছেলেপুলে ছিল না, সে ছেলেটাকে নিজের ছেলের মতো করে বুকে আগলে রাখল। পাছে ছেলেটাকে তার মা বাবা কোনওদিন চিনতে পেয়ে দাবি করে বসে সেই জন্য পরে বউয়ের আবদারে তীর্থ থেকে ফিরে এসে ছেলেটার বাড়ি থেকে তার সব ছবি চুরি করে নিয়ে যায়। ওদিকে বড়-সদারের মতি ফেরানোর জন্য তার বউ তীর্থে-তীর্থে ঘুরে বেড়াত খুব। সঙ্গে-সঙ্গে ছেলেটাকেও রাখত। তা বড়সদারের মতিগতি ভালর দিকেই চলে যাচ্ছিল। কিন্তু বছর দুই আগে যেই বউ মরল অমনি আবার পুরনো পোকা মাথায় কিলবিল করে উঠল। সদার আমাকে গোপনে বলেছে, ছেলেটার বাবার অবস্থা এখন পড়তির দিকে। টাকা চেয়েও লাভ হবে না। তার চেয়ে ছেলেটাকে ডাকাতির তালিম দিয়ে ছেড়ে দিলে বুড়ো বয়সে দুটো পয়সার মুখ দেখা যাবে।”
বিড়ি-চোর বড়বড় চোখ করে গল্প শুনছিল। একটা ঢোক গিলে বলে, “তাহলে মেজ-সদার কোন্ বাড়ির ছেলে?”
“সে কথা সদার প্রাণ গেলেও বলবে না।”
“আমার তো সন্দেহ হয়”
“আমারও হয়। কিন্তু কথা চেপে রাখ। নইলে গোলমালে পড়বি।”
মেজ-সদার রাজবাড়ির দেওয়ালে-দেওয়ালে অয়েল পেইন্টিং দেখে দেখে ঘুরে বেড়াচ্ছে। পিছনে ডাকাতের দল, কিন্তু তারা সদারের ভাবসাব দেখে কিছু বুঝতে পারছে না। ছবি দেখবে তো পটের দোকানে গিয়ে যত খুশি দেখো, না হয় একজিবিশনে যাও, ডাকাতি করতে এসে ছবি দেখার কথা তারা জন্মে শোনেনি।
একসময়ে ছবি দেখা শেষ করে মেজ-সদার গম্ভীর ভাবে বলে, “হুঁ।”
কানাই গলা বাড়িয়ে বলে, “কিছু বুঝলে সর্দার?”
মেজসদার গম্ভীর মুখে বলে, “চোর-কুঠুরি কোথায় তা এবার জলের মতো বুঝতে পারছি। এই পুব দিকের দেয়ালে এবংশের তৃতীয় রাজা হেরম্বনারায়ণের ছবি। এ ছবিতে হেরম্বনারায়ণের বাঁ হাতের কড়ে আঙুলটা যেদিকে বেঁকে আছে সেটা হল চোর-কুঠরিতে যাওয়ার প্রথম পথ। পথটা অন্দরমহলে গেছে। সেখানে গোঁসাঘরের বাইরের দেওয়ালে পঞ্চম রাজা ভীমনারায়ণের ছবি আছে, তাঁর ডান হাতের তর্জনী চোরকুরিতে যাওয়ার দ্বিতীয় পথটা চিনিয়ে দেবে। সে পথ ধরে গেলে একটা মস্ত শোবার ঘর পাওয়া যাবে। সেখানে দেওয়ালে নবম রাজা পবননারায়ণের ছবিটা ভাল করে দেখলে দেখা যাবে যে, তিনি মেঝের দিকে তাকিয়ে কুঁচকে কী যেন খুঁজছেন। অর্থাৎ আমাদেরও মেঝেতেই খুঁজতে হবে। মেঝেটা ভাল করে খুঁজলে কয়েকটা সূক্ষ্ম চিহ্ন দেখা যাবে। সেগুলো অনেকটা তীরের ফলার মতো। সেই চিহ্ন ধরে হামাগুড়ি দিয়ে এগোলে খাটের তলায় এক জায়গায় গুপ্ত দরজা দেখা যাবে।”
সবাই অবাক। কানাই বলে, “কী করে বুঝলে এত সব?”
মেজ-সদার ভু কুঁচকে বলে, “কে জানে কী করে বুঝলাম! কিন্তু আমার সব মনে পড়ে যাচ্ছে যেন।”
বিড়ি-চোর বলে, “সদারের মাথা খুব পরিষ্কার।” মেজ-সদারের পিছু পিছু ডাকাতরা এগোতে লাগল। ঠিক এই সময়ে একটা বিশাল কালো চেহারা এক তলা থেকে এক লাফে রাজবাড়ির দোতলায় উঠে গেল। দরবার-ঘরের দরজা থেকে একটা টর্চের ঝলকানি এল, সেই সঙ্গে গুডুম করে গুলির শব্দ।
গণেশবাবু ভৈরবীতে চমৎকার বিলম্বিত করছিলেন। গুলির শব্দ হতেই তিনি দড়াম করে মেঝেতে পড়ে নিশুপ হয়ে গেলেন।
ভজবাবু খানিকটা হতভম্ব হয়ে রইলেন। ডাকাতদের কারও বন্দুক পিস্তল নেই, তিনি জানেন। তবে কি পুলিশ? সন্দেহ হতেই ভজবাবু বিপুল বিক্রমে খাঁড়া ঘোরাতে ঘোরাতে বীরদর্পে কবিতা আবৃত্তি করতে লাগলেন।
কে যেন সতর্ক গলায় ডাকল, “ছোড়দা!”
আর একজন বলল, “মেজকাকু।”
মেঝে থেকেই বরদাচরণ বললেন, “দোহাই ভজবাবু।”
ভজবাবু একটু থমকে গেলেন। তারপর গম্ভীর গলায় বললেন, “নহি দাদা, নহি আমি কারও মেজকাকু। সম্মুখসমরে আত্মীয়তা ঘোর দুর্বলতা। ছাড়ো দ্বার, যাবো অস্ত্রাগারে…”
মেঝে থেকে বরদাচরণ প্রায় কেঁদে ফেলে বললেন, “ভজবাবু, দোহাই আপনার, শিগগির শুয়ে পড়ুন যদি বাঁচতে চান। একটা লাশ পড়েছে, আপনাকেও গুলি করবে।”
দরজার কাছ থেকে হারাধন বলে ওঠে, “কারও লাশ পড়েনি। গুলি আমি ছাদে চালিয়েছি।”
বরদাচরণ বলেন, “তা হলে গণেশবাবু?”
রাজমাতা ডুকরে উঠে বললেন, “ওরে, আমার গোবিন্দকে তোরা কী করেছিস?”
মেজ-সদার গম্ভীর গলায় বলে, “সে ভাববেন না ঠাকুমা, রাজামশাই দাঁড়িয়ে আছেন সামনের দিকের বারান্দায়।”
“আর আমার খুঁটে? কাল যে নন্দী বাড়ির চাকর পাঁচশো খুঁটে নিতে আসবে।”