রাজমাতার ভাল ঘুম হয় না। মাথায় রাজ্যের চিন্তা। সারাদিন খুঁটে দেন, সেই ঘুঁটে শুকিয়ে পাহাড়প্রমাণ জমিয়ে রাখেন রাজমাতা খুঁটে বিক্রি করলে নিন্দে হবে, সেইজন্য নিজে না বিক্রি করে বুড়ি দাসীকে দিয়ে বিক্রি করেন। তাতে বেশ দু পয়সা আয় হয় তাঁর। কিন্তু তিনি যতই গোপন করুন রাজ্যিসুব্ধ সবাই জানে যে, রাজমাতার খুঁটের ব্যবসা আছে। ঘুঁটে অবশ্য তিনি ভালই দেন, সেজন্য লোকে তাঁর প্রশংসাও করে। রাজমাতার দুশ্চিন্তা হল সেই খুঁটে নিয়েই। কখন কোন ফাঁকে চোর এসে খুঁটে চুরি করে নিয়ে যায়, তা ভেবে রাতে তাঁর ঘুম হয় না। এ রকম কয়েকবারই চুরি গেছে। কতবার ছেলে গোবিন্দনারায়ণকে বলেছেন, “আমাকে একটা নেড়ী কুকুর এনে দে, পুষি। সে আমার খুঁটে পাহারা দেবে।” কিন্তু তাঁর রাজা-ছেলে সেকথা কানে নেয়নি।
রাজমাতার আরও দুশ্চিন্তা একমাত্র নাতিটার কথা ভেবে। সে যে কোথায় নিরুদ্দেশ হয়ে রইল।
এইসব ভেবে তাঁর ঘুম আসে না। রাতবিরেতে জেগে বসে মাথা চুলকোন। বড় উকুন হয়েছে। আজও চুলকোচ্ছিলেন। হঠাৎ হট্টগোল শুনে উঠে বসে ছেলের বউকে ডাকতে লাগলেন, “অ বউমা, ওঠো তো! ও কারা গণ্ডগোল করছে?”
রানীমারও ঘুম নেই। এক কথা, ছেলে নিরুদ্দেশ। তা ছাড়া কিপটে রাজার ঘর করেন বলে তাঁকে সব সময় সংসারের নানা দুশ্চিন্তা করতে হয়। ঘুম তাঁরও হয় না। শাশুড়ির গলা শুনে বললেন, “শুনছি মা। মনে হচ্ছে ডাকাত-টাকাত পড়েছে।”
“হায় ভগবান! ডাকাতই যদি পড়েছে তবে শুয়ে আছ কেন? ওঠো দেখি কী হল।”
রানী-মা নিশ্চিন্ত গলায় বললেন, “উঠে হবেই বা কী! ডাকাতরা ঘুরে ফিরে নেওয়ার মতো জিনিস না-দেখে নিজেরাই লজ্জা পেয়ে ফিরে যাবে।”
রাজমাতা মশারি তুলে বেরিয়ে আসতে-আসতে বললেন, “ নেওয়ার জিনিস নেই মানে? এখনও আমার তিন হাজার চারশ পঞ্চান্নখানা খুঁটে জমা আছে, তা জানো?”
“ডাকাতরা ঘুঁটে নিতে আসে না মা।”
“চোর-কুঠুরিতে আমাদের লক্ষ লক্ষ টাকা আছে তা জানো?”
“সব অচল।”
রাজমাতা বিরক্ত হয়ে বললেন, “আহা, না হয় নাই নিল কিছু কিন্তু আমার গোবিন্দকে যদি মারধোর করে? চলো দেখি গিয়ে।”
রানী-মা উঠে পড়লেন। ডাকাতরা যে মারধোর করতে পারে এটা তাঁর আগে খেয়াল হয়নি।
এদিকে দরবার-ঘরে গোয়েন্দা বরদাচরণের অবস্থা খুবই করুণ। মনোজদের বাড়িতে ঢুকতে গিয়ে দেওয়াল থেকে পড়ে মাজায় ব্যথা পেয়েছিলেন, এখন সেই ব্যথার ওপর আবার সিংহাসনের সঙ্গে ধাক্কা লেগে আরও অচল হয়ে পড়েছেন। যাকে বলে চলচ্ছক্তিহীন। তা ছাড়া, পালাতে গেলে প্রাণ যাবে বলে ভজবাবু শাসিয়ে রেখেছেন। সেকথাটা অবিশ্বাসই বা করেন কী করে? ভজবাবুর হাতে খাঁড়া, ভাবসাবও ভাল নয়।
বরদাচরণ মেঝেয় পড়ে ব্যথায় কোঁকাচ্ছেন আর তাঁর দু পাশে দাঁড়িয়ে ভজবাবু আর গণেশ ঘোষাল প্রচণ্ড ঝগড়া করছেন। ঝগড়া করতে করতে উত্তেজিত ভজবাবু মাঝে মাঝেই খাঁড়া বাঁইবাঁই করে ঘোরাতে থাকেন। তাতে বরদাচরণ ভয় পেয়ে চেঁচিয়ে ওঠেন, “দোহাই ভজবাবু! খাঁড়া সামলে। নাকে মুখে লেগে যাবে যে!”
কিন্তু কে শোনে কার কথা। ভজবাবু বুক চিতিয়ে বলছেন, “এঃ! বলে সারেগামা জানি না! আপনি জানেন? করুন দেখি সারেগামা।”
গণেশ ঘোষালও বুক চিতিয়ে বলেন, “সারেগামা আমাকে করতে বলছেন, ভাল কথা। কিন্তু করলে বুঝবেন কি? গানের ‘গ’ ও তো জানেন না। অথচ আজ প্রকাশ্যে সুরের অপমান করে সারা শহর ঢি ঢি ফেলে দিয়েছেন।”
রাগে ভজহরিবাবু বাঁইবাঁই করে আরও কয়েকবার খাঁড়া ঘোড়ালেন। আতঙ্কে চিঁ চিঁ করে বরদাচরণ বলতে থাকেন, “খাঁড়া সামলে, ভজবাবু! আর-একটু হলে-”
গণেশ ঘোষাল একটু ব্যঙ্গের হাসি হেসে বলেন, “হ্যাঁ, ওই খাঁড়া ঘোরানো, পিস্তল দিয়ে ভয় দেখানো, এসবই আপনাকে তবু মানায়। কিন্তু গান নয়। শুনুন” এই বলে গণেশবাবু খুব আবেগ দিয়ে বাঁ হাতে নিজের বাঁ কান চেপে ধরে ডান হাতটা ভজবাবুর মুখের সামনে একটু খেলিয়ে তান ধরলেন, “সা…রে….গা….মা, কোন স্কেলে ধরেছি বলুন তো?”
ভজবাবু একটু থমকে গিয়ে বলেন, “স্কেল? গানের মধ্যে আবার স্কেল কী মশাই? এ কি হাতের লেখা নাকি যে রুল টানতে স্কেল চাই! নাকি গলার দৈর্ঘ্য-প্রস্থ মেপে দেখবেন।”
“হাঃ হাঃ! বেনাবনে মুক্তো ছড়ানো। স্কেল কাকে বলে তাই যখন জানেন না, তখন আর গেয়ে হবেটা কী? তবু গানের মধ্যে যে সম্মোহনী শক্তি আছে তাতে আপনার মতো অসুর লোকেরও হয়তো উপকার হতে পারে। তাই শোনাচ্ছি! শুনুন, সা…রে…গা..মা…”।
ডাকাতদলের প্রচণ্ড চেঁচামেচি, গণেশবাবুর গলা সাধা, বরদাচরণের ক্ষীণ আর্তনাদ মিলেমিশে সে এক বিটকেল কাণ্ড।
মেজ-সদার তার কয়েকজন স্যাঙাত নিয়ে এ-ঘর ও-ঘর খুঁজে বেড়াচ্ছে। হঠাৎ একবার থমকে দাঁড়িয়ে সদার তার মশালটা তুলে দেয়ালে একটা মস্ত তৈলচিত্র দেখে কানাইকে বলল, “ওটা কার জানিস?”
কানাই বলে, “কার?”
মেজ-সদার শ্বাস ফেলে বলে, “আমিও জানি না। তবে খুব চেনা-চেনা ঠেকছে। এ পুরো বাড়িটাই আমার খুব চেনা লাগছে।”
কানাই উৎসাহ পেয়ে বলে, “তবে চোর-কুঠুরিটা কোথায় তা খুঁজে বের করে ফেল।”
মেজ-সদার ধমক ছেড়ে বলে, “চোপ! চোর কুঠুরি চোর কুঠুরি করে গলা শুকাবি না। আগে আমাকে সব দেখতে দে।”
কানাই ভয় খেয়ে চুপ করে যায়।