“সব লুঠ হয়ে গেল বড়বাবু!”
দারোগাবাবু ফের পাশ ফিরে বললেন, “লুঠ করে যাবে কোথায়? কাল সকলেই সব কটাকে ধরে ফেলব।”
“খুন-খারাবি হবে যে!”
“খুন করতে বারণ করে দে। একটু ভয় দেখিয়ে দিবি। বলবি খুন করলে ফাঁসি হবে। লুঠ করলে জেল।”
লোকটা কাকুতিমিনতি করতে থাকে। অনেকক্ষণ বাদে ঘুমের ঘোর ভেঙে দারোগাবাবু বলেন, “ওঃ বাবা! এক দিনে আর কত হবে। মাডারার, হনুমান, ডাকাত! ব্যাটারা পেয়েছে কী আমাকে। আমি কি ওদের চাকর যে যা খুশি করবে আর আমাকে দৌড়ে বেড়াতে হবে!”
কিন্তু কর্তব্যবশে দারোগাবাবুকে উঠতেই হল। পোশাক পরে মা কালীকে ভক্তিভরে প্রণাম করে বললেন, “মা গো। আমি যাওয়ার আগেই যেন ডাকাতি করে ডাকাতরা সরে পড়ে। ধর পাকড়ের অনেক হাঙ্গামা মা।”
.
বরদাচরে ঘুম কুকুরের ঘুমের মতো পাতলা। গোয়েন্দাদের এটাই গুণ। ফটক ভাঙার শব্দে ঘুম ভেঙে উঠে বসেছেন তিনি। রাজবাড়ি থেকে তাঁকে শোওয়ার জন্য একটা মোটা কুটকুটে কম্বল দিয়েছে, তাই সারা গা চুলকোচ্ছিল।
বরদাচরণ গা চুলকোতে চুলকোতে বেরিয়ে এসেই ভজবাবুর একেবারে মুখোমুখি পড়ে গেলেন। দেখলেন, ভজবাবুর হাতে খাঁড়া, কপালে তেল সিঁদুরের ছাপ, কানে জবাফুল, কণ্ঠে গান। ভজবাবু খাঁড়াটা ঘোরাতে ঘোরাতে গেয়ে ওঠেন, “ছুঁসনে আমাকে, দূরে দূরে থাক, নইলে মাথাটা করব দুফাঁক, ওরে গোয়েন্দা পাজি…”
কিন্তু ভজবাবুকে ছোঁওয়ার ইচ্ছে বরদাচরণের একটুও নেই। ছুঁয়ে হবেটা কী? এত রাতে কারই বা চোর-পুলিশ খেলতে ইচ্ছে যায়? তিনি বললেন, “ভজবাবু, এত রাতে কী ব্যাপার?”
পিছন থেকে ডাকাতরা রে-রে করে ওঠে। বরদাচরণ পিস্তলের জন্য খাপে হাত দিলেন। পিস্তল নেই। আর পিস্তলহীন গোয়েন্দা যে কত অসহায় তা বুঝতে পেরে বরদাচরণ পিছু ফিরে দৌড় লাগালেন।
কিন্তু পারবেন কেন? দৌড়ে হয়তো পারতেন, কিন্তু প্রথমেই সিংহাসনে হোঁচট খেয়ে মেঝেয় পড়লেন। উঠে ছুটতে গিয়ে ফের দেওয়ালে ধাক্কা লাগল।
ভজবাবু এসে দাঁড়িয়ে গাইতে থাকেন, “বলো আজ তুমি কোথায় পালাবে, যেখানেই যাও সেখানেই যাবে দরা তোর পিছনে…”
“হচ্ছে না! সুর হচ্ছে না।” অন্ধকারে কে যেন চেঁচিয়ে বলে ওঠে।
ভজবাবু রেগে গিয়ে বলেন, “কে বলে সুর হচ্ছে না?”
“আমি বলছি,” বলে ডাকাতদের ধাক্কা দিয়ে সরিয়ে গণেশবাবু ঘরে ঢুকে বলেন, “গানটা ইয়ার্কি নয় ভজবাবু! শিখতে হয়। ওটা কীরকম গান হল শুনি! সর্বেশ্বর কারফমার ‘দস্যু নৃত্যনাট্য আমি নিজে ডিরেকশন দিয়েছি কতবার। শুনবেন? তাহলে শুনুন।” বলে গণেশবাবু হাত নেড়ে নেড়ে গাইলেন, “বলো আ…আজ তু..উম কোথায় পা..আলাবে…”
ভজবাবু বিরক্ত হয়ে বললেন, “কাজের সময় এখন দিক করবেন না তো গণেশবাবু! আমি এখন ডাকাতদের ডিরেকশন দিচ্ছি…”
“এঃ, ডিরেকশন যত খুশি দিন, তা বলে গানের অপমান আমি সহ্য করব না।”
এ নিয়ে একটা ঝগড়া বেধে উঠল বেশ।
মেজ সদার বা অন্য ডাকাতরা এসব ঝগড়া কাজিয়া দেখে ভূক্ষেপ করল না। তারা কাজ হাসিল করতে এসেছে। ঝগড়া কাজিয়া নিয়ে মাথা ঘামালে চলবে কেন?
মেজ সদার গিয়ে সোজা গোবিন্দনারায়ণের গলায় খাঁড়া ধরে বলল, “চাবিগুলো দিয়ে দিন রাজামশাই।”
রাজা গোবিন্দনারায়ণ বললেন, “তাঁতিরাচি গামা হন্ডুরাস।”
মেজসদার অবাক হয়ে বলে, “তার মানে?”
রাজামশাই আবার বলেন, “গিমি গড়গড়ি কেরোসিন বোম।”
মেজসদার হাঁ করে চেয়ে থেকে বলল, “ওরে তোরা শোন তো এসে, রাজামশাই কী ভাষায় কথা বলছে।”
রাজামশাই নিজেও তা বুঝতে পারছিলেন না। তাঁর মনে হচ্ছিল বোধহয় দৈবক্রমে তিনি স্বপ্নাদ্য কোনও নতুন ভাষা শিখে ফেলেছেন। অর্থ না বুঝলেও তাঁর মুখ দিয়ে অনবরত ওই সব কিম্ভুত কথা বেরিয়ে যাচ্ছে। এবার তিনি বললেন, “গমেসি গদাধর ভাগভাগ ফুংকাসুন।”
কানাই খুব মন দিয়ে শুনে বলে, “নাঃ, বোঝা যাচ্ছে না। তেলুগু হতে পারে।”
বিড়ি-চোর বলে, “তেলু টেলু নয়। আমি সেবার পাহাড়ে গিয়ে ঠিক এই ভাষা শুনে এসেছিলাম। তবে মানে বলতে পারব না।”
একটা অল্পবয়সী ডাকাত বলল, “রাজাদের ব্যাপারই আলাদা। তারা কি আর আমাদের ভাষায় কথা বলে নাকি? আর কথায় কাজই বা কী?”
মেজদারও বলে, “ঠিক বলেছিস। এত কথায় কাজ কী? কানাই, রাজামশাইয়ের কোমরের ঘুনসি থেকে চাবির গোছাটা খুলে দে তো।”
কানাই চাবির গোছা খুলে নিল।
রাজামশাই শুধু বললেন, “সামসাদিঘি টক দৈ হামলা খামলা।” বলতে বলতে রাজামশাই তখনও অবাক হয়ে ভাবছেন যে, তাঁর মুখ দিয়ে এসব কথা বেরোচ্ছে কী করে। মনে-মনে তিনি যা ভাবছেন তা বুঝতে তাঁর অসুবিধে হচ্ছে না। কিন্তু যেই সেকথা বলতে চাইছেন অমনি তাঁর জিভ যেন বদমাইশি করে কথাগুলোকে অন্য একটা বিদঘুঁটে ভাষায় ট্রানসলেট করে দিচ্ছে। যেমন তিনি এখন বলতে চাইছিলেন ‘বাবারা, হামলা কোরোনা, যা চাও নিয়ে যাও।’ এর মধ্যে কোত্থেকে সামসাদিঘি বা টক দৈ আসে তা বোধের অগম্য।
ডাকাতরা চাবি খুলে নিয়ে রাজামশাইকে একা রেখে চলে গেল। রাজামশাই দাঁড়ানো অবস্থাতেই মূৰ্ছিত হয়ে রইলেন। এটা অবশ্য তাঁর পুরনো অভ্যাস, দাঁড়িয়ে মূছ যেতে তাঁর কোনও অসুবিধেই হয় না।
অন্দরমহলের একটা বড়-সড় ঘরে রাজমাতা আর রানী-মা দুটো পাশাপাশি খাটে শোন। মাঝখানে মেঝেয় শোয় রাজবাড়ির পুরনো দাসী।