মশাই।” হারাধন বলল, “কিন্তু পাখিগুলো এখনও চেঁচাচ্ছে কেন?”
“গণেশবাবুও আছেন যে!” বলতে না বলতে টিয়ার খাঁচার পেছন থেকে গণেশবাবু বেরিয়ে আসতে আসতে বললেন, “গান গাইলেই হল না কি না! সবাই যদি গান গাইতে পারত তবেই হয়েছিল আর কি!”
হারাধন অবাক হয়ে বলে, “হঠাৎ গানের কথা কেন?”
গণেশবাবু বললেন, “ওই তো শুনলেন সরোজ আর মননজের মুখে, ভজবাবু নাকি গান গাইতে গাইতে ডাকাতি করতে যাচ্ছেন। ডাকাতি করা খারাপ কাজ বটে, কিন্তু যে গানের গ জানে না তার গান গাওয়া ডাকাতির চেয়েও খারাপ কাজ।”
হারাধন বলে, “তা বটে, কিন্তু মেজদা তো কখনও ভুলেও গান গায় না।”
গণেশবাবু গায়ের ধুলো-টুলো ঝেড়ে বললেন, “আপনার এই চিড়িয়াখানাটা বড় জব্বর জায়গা মশাই। যে ঘরেই লুকোতে যাই সে ঘরেই ডিসটার্বেন্স। এ ঘরে গেলে হনুমান দাঁত খিচোয়, ও ঘরে সাপ ফোঁস ফোঁস করে, সে ঘরে ব্যাং ডাকে, এ ঘরটায় পাখিদের কী কিচির মিচির বাবা! এর চেয়ে ভজবাবুর গান শোনা ভাল। চলো দেখি সরোজ মনোজ, তোমাদের মেজকাকু কেমন গাইছে সেটা শুনে আসি।”
দুঃখবাবু মনের দুঃখে বলে, “সবাই গেলে আমিই বা একা থাকি কী করে? এ বাড়ি খুব সেফ নয়। চলুন আমিও না হয় একটু ঘুরে আসি।”
.
রাত্রিবেলা রাজা গোবিন্দনারায়ণের ভাল ঘুম হয় না। তার কারণ হল, শোওয়ার আগে তিনি কোমরে একটা মোটা ঘুনসিতে রাজবাড়িতে যত চাবি আছে সব বেঁধে নিয়ে তবে ঘুমোতে যান। রাজবাড়ির চাবির সংখ্যা কম নয়। দেউড়ির চাবি থেকে শুরু করে ভাঁড়ারের চাবি মিলিয়ে ছোট বড় শত খানেক তো হবেই। কোমরের চারধারে গোল, মোটা, লম্বা, ছোট বড় হরেক চাবি ঝুলিয়ে রাজা যখন শোন তখন সেগুলো গায়ে ফোটে। তার ওপর একটু নড়লে চড়লেই চাবিগুলোর ঝনঝন করে বিকট শব্দ হয়।
গোবিন্দনারায়ণের আজ রাতে ঘুম না হওয়ার একটা তৃতীয় কারণও আছে। গোয়েন্দা বরদাচরণের কাছ থেকে তিনি আজই। জানতে পেরেছেন যে, চোরকুঠুরির জমানো টাকাগুলো সবই অচল। তাঁর অবশ্য বিশ্বাস হয়নি। তাই সন্ধের পর তিনি চোরকুঠুরি থেকে দুটো টাকা বের করে চাকরকে বাজারে পাঠিয়েছিলেন মুড়ি কিনে আনতে। চাকর এসে টাকা দুটো ফেরত দিয়ে বলেছে, “দোকানদার জিজ্ঞেস করল এ নোট দুটোয় কি উটের ছবি ছাপা আছে?”
গোবিন্দনারায়ণ তখন থেকে শোকমগ্ন। তার ওপর হাড় হাভাতে গোয়েন্দাটা মহা জ্বালাতন শুরু করেছে তখন থেকে। কেবল বলছে, “আপনি আমার মাস মাইনেটা কি ওইসব টাকা দিয়ে দেবেন নাকি? আপনার মতলব তত ভাল ঠেকছে না।“
গোবিন্দনারায়ণ তাকে যতই ধমকান সে কিছুতেই শোনে না। কেবল বলে, “ও হোঃ হোঃ, আমি যে অনেক আশা করে কেসটা হাতে নিয়েছিলাম!”
তর্কে বিতর্কে রাত হয়ে যাওয়ায় বরদাচরণ আর বাড়ি ফেরেননি, তিনি রাজা গোবিন্দনারায়ণকে বলেছেন, “সকাল হলে আমি রাজবাড়ির রূপোর বাসন নিয়ে গিয়ে বাজারে বেচে দেব।” এই বলে গোয়েন্দাটা রাজার হেঁসেলে রাতের খাওয়া সেরে বাইরের দরবার ঘরে ঘুমোতে গেছে।
সেই থেকে গোবিন্দনারায়ণের ঘুম নেই। চোর কুঠুরির সব টাকা অচল। গোয়েন্দা সকালবেলা রুপোর বাসন নিয়ে যাবে। ভাগ্নেটা গাওয়া ঘিয়ের লুচি খেয়ে গেল।
.
রাত বারোটার পর গোবিন্দনারায়ণ আর বিছানায় থাকতে পারলেন না। এই শীতেও বিছানাটা গরম ঠেকছে। উঠে চাবির শব্দ তুলে একটু পায়চারি করছিলেন। সে সময়ে শুনতে পেলেন কে যেন দেউড়ির কাছে গান গাইছে, “দরজা খোলো হে, ঝটপট খোলো, দাঁড়িয়ে রয়েছি আমরা…”
গান গোবিন্দনারায়ণের খারাপ লাগে না। তিনি তাই ভাল করে শোনার জন্য দোতলার অলিন্দে এসে দাঁড়ালেন। আর দাঁড়িয়েই মূৰ্ছিত হয়ে রইলেন কিছুক্ষণ।
ভজবাবু উঁচু গায় গাইলেন, “দরজা যদি না খোলো তবে আজ টেনে তুলে নেব চামড়া…”
রাজবাড়ির দুচারজন বুড়ো দারোয়ান এখনও অবশিষ্ট আছে। তারা সব ঘুমোচ্ছিল, গান শুনে উঠে সবাই বাইরে এসে ফটকের বাইরের দৃশ্য দেখে হাঁ।
মেজ সদর বাইরে থেকে গর্জন করে ওঠে, “এই! সব হাঁ করে দেখছিস কী? ফটক খুলে দে!”।
একজন বুড়ো দারোয়ান চাবির জন্য রাজার কাছে দৌড়ে এল। রাজা মূর্ছা ভেঙে বললেন, “দুগা দুর্গতিনাশিনী! গোয়েন্দাটা বসে বসে মাইনে খায়, ওটাকে ঘুম থেকে তুলে দে তো! আর দৌড়ে পিছনের ফটক দিয়ে গিয়ে পুলিশে খবর দে।”
দারোয়ান চলে গেল।
বাইরে ভজবাবু গেয়ে উঠলেন, “লাথি মেরে ভাঙব তালা, দারোয়ান দৌড়ে পালা, বাঁচতে যদি চাস..”
মুহূর্তের মধ্যে চল্লিশ-পঞ্চাশটা মশাল জ্বলে উঠল। সেই সঙ্গে রাজবাড়ির পুরনো মরচে পড়া ফটকে দমাদম লাথি পড়তে থাকে।
কয়েক মুহূর্তের মধ্যে ফটক ভেঙে ডাকাতরা রাজবাড়ির মধ্যে ঢুকে পড়তে থাকে।
.
দারোগাবাবু রাতে কিছু খাননি। দু চুমুক দুধ বার্লি খেয়ে শুয়ে মা কালীর নাম করছিলেন। একটা সেপাই তার গা হাত পা টিপে দিচ্ছিল।
সদ্য ঘুমটা এসেছে এমন সময় থানা থেকে লোক এসে খবর দিল, “রাজবাড়িতে ডাকাত পড়েছে। যেতে হবে।”
শুনে দারোগাবাবু দুঃস্বপ্ন মনে করে এক পাশ থেকে আর এক পাশ ফিরে শুলেন।
কিন্তু থানার লোকটা ছাড়ে না। কেবল ডাকাডাকি করে, “বড়বাবু, উঠুন, রাজবাড়িতে ডাকাত পড়েছে।”
ঘুম-চোখে দারোগাবাবু বললেন, “রাজবাড়ির ডাকাত তো। আমাদের বাড়ির তো নয়! আমাদের কী তাতে?”