সররাজের হাতে একটা হকি স্টিক আর মননজের হাতে একটা ক্রিকেটের স্টাম্প। দুজনে শহরের উত্তর ধারে চলে এসেছিল।
জায়গাটা আগাছা আর জঙ্গলে ভরা। রাত নিশুত। এ অঞ্চলে লোকজনের বসবাস খুবই কম। শোনা যায়, এ অঞ্চলের বাসিন্দারা খুব একটা ভাল লোক নয়। দিনের বেলাতেও ভয়ে লোক এদিকে আসে না।
মনোজ হঠাৎ সরোজের হাত টেনে ধরে বলে, “এই দাদা!”
সরোজ থমকে গিয়ে বলে, “কী?”
“গান শুনছিস?”
সোজ কান পেতে শোনে। ঝিঁঝির ডাক, গাছের পাতায় বাতাসের শব্দ আর ঘুম ভাঙা পাখির অস্পষ্ট ডাক, মাঝে মাঝে শেয়ালের “হুয়া, হুয়া”। এইসব ভেদ করে অনেক দূর থেকে ক্ষীণ একটা গানের শব্দ আসছে বটে। কে যেন গাইছে, “ভাঙব লোহার কপাট ভাই, আর তো কোনও শঙ্কা নাই.”
সরোজ বলল, “এ দিকেই আসছে!”
মনোজ খানিকটা গান শুনে বলল, “মেজকাকার গলা।”
“যাঃ!”
“দেখিস। ওই শোন আরও কাছে এসে গেছে। ওই দ্যাখ মশালের আলো! দাদা, লুকিয়ে পড়।”
দুই ভাই তাড়াতাড়ি গাছপালার মধ্যে লুকিয়ে পড়ে চেয়ে রইল। তারপর যা দেখতে পেল তা প্রত্যয় হয় না। তারা দেখল, ভজবাবু গান গাইতে গাইতে বিশাল এক দল ডাকাত নিয়ে চলেছেন।
দলটা দুই ভাইয়ের একেবারে নাকের ডগা দিয়েই যাচ্ছিল।
সরোজ বলে, “মেজকাকার হাতে খাঁড়া।”
মনোজ বলে, “মেজকাকার চোখ চকচক করছে।”
সরোজ বলে, “মেজকাকার হল কী?”
মনোজ হঠাৎ মেজকাকার পাশে মশাল হাতে মেজ সদারকে দেখতে পেল। একটু চমকে উঠল সে। কিন্তু শব্দ করল না।
ডাকাতের দল তাদের ছাড়িয়ে এগিয়ে যেতে থাকে। ভজবাবু তখন গাইছেন, “বুকের ভিতরে ঘোড়া ছুটে যায়, ওরে তোরা ছেড়ে দে ছেড়ে দে আজ আমারে…”
সরোজ একটু ভেবে চিন্তে বলে, “মনে হচ্ছে, ডাকাতরা মেজকাকাকে কোথাও ধরে নিয়ে যাচ্ছে, তাই ছেড়ে দেওয়ার জন্য গান গাইছে মেজকাকা।”
মনোজ মাথা নেড়ে বলে, “মেজকাকাকে ধরে নিয়ে যাচ্ছে না, মেজকাকাই ডাকাতদের নিয়ে যাচ্ছে।”
সরোজ বলে, “কিন্তু মেজকাকার যে দারুণ চোর-ডাকাত আর ভূতের ভয়!”
একটু দূর থেকে ভজবাবুর গলার গান ভেসে আসছিল, “সামনে রাজার বাড়ি, চল যাই তাড়াতাড়ি, বিবাদ-বিসম্বাদ থামা রে…”
মনোজ সবরাজের হাত চেপে ধরে বলল, “দাদা, ডাকাতদের নিয়ে মেজকাকা রাজবাড়ির দিকে যাচ্ছে। এক্ষুনি ছোটকাকাকে খবরটা দেওয়া দরকার।”
সরোজ বিরক্ত হয়ে বলে, “অত ঝামেলায় কী হবে? চল তার চেয়ে মেজকাকাকেই গিয়ে ধরলেই তো হয়। বলব, শিগগির বাড়ি চলো, বাবা ডাকছে। বাবা ডাকছে শুনলেই সুড়সুড় করে চলে আসবে।”
মনোজ মাথা নেড়ে বলে, “দূর, তুই মেজকাকাকে ভাল করে দেখিসনি। দেখলি না, মেজকাকার চোখ কেমন চকচকে, মুখটা ফোলা ফোলা, হাতে খাঁড়া, গলায় গান! এ সেই মেজকাকাই নয়, দেখলে আমাদের চিনবেই না। আর ডাকাতরাই বা ছাড়বে কেন? চল, বাড়ি গিয়ে ছোটকাকাকে ডেকে আনি।”
দুই ভাই বাড়ির দিকে দৌড়তে থাকে। বাড়ির ফটকেই ঠাকুরঝি। তাঁর সাদা থান তিনি মালকোঁচা মেরে পরেছেন, হাতে টর্চ, লাঠি, আর কোমরে দড়ি দিয়ে বাঁধা একটা হাত দা। ঠাকুরমা উঠোনের দরজায় চুপটি করে বসে চোখের জল মুছছেন। মা তাঁর পিছনে দাঁড়িয়ে।
সরোজ আর মনোজ ফটকের দিকে গেল না। ছোটকাকা হারাধন বলেছিল, ভাল করে তৈরি হয়ে বেরোতে তার কিছু দেরি হবে। দুই ভাই তাই গিয়ে ল্যাবরেটরিতে ঢোকে।
ঢুকতেই দেখে, হারাধন তৈরি হয়ে বেরোচ্ছে। একটা গোরিমানকে শিকলে বেঁধে নিয়েছে হারাধন, অন্য হাতে একটা টস্তল (টর্চ+পিস্তল, এটা হারাধনের নিজের আবিষ্কার, একই সঙ্গে টর্চ এবং পিস্তলের কাজ করে), আর তার কাঁধে সেই বদমাশ কাকটা বসে আছে। পাখির ঘরে পাখিগুলো খুব চেঁচাচ্ছে।
মনোজ হাঁফাতে হাঁফাতে বলে, “ছোটকাকা, মেজকাকা ডাকাতের দল নিয়ে রাজবাড়ি লুট করতে যাচ্ছে। শিগগির চলল। “
হারাধন আকাশ থেকে পড়ে বলে, “মেজদা! ডাকাতের দল নিয়ে! রাজবাড়ি! আর কী বললি?”
সরোজ : “লুট করতে…”
মনোজ : “যাচ্ছে…”
হারাধন চোখ বুজে দাঁড়িয়ে বলল, “আবার বল। এবার একটু আস্তে আস্তে।”
সরোজ আর মনোজ পালা করে বলল। পাখির ঘরে পাখিরা খুব চেঁচাচ্ছে এখনও। হারাধন পিছনে ফিরে ঘরটা দেখে নিয়ে বলল, “পাখিগুলোর আজ হল কী? যাকগে। যা, রাজবাড়ি। রাজবাড়িই বললি তো!”
সরোজ আর মনোজ পালা করে বলল। পাখির ঘরে পাখিরা খুব চেঁচাচ্ছে এখনো। হারাধন পিছনে ফিরে ঘরটা দেখে নিয়ে বলল, “পাখিগুলোর আজ হল কী? যাকগে। তাঁ, রাজবাড়ি। রাজবাড়িই বললি তো!”
সরোজ আর মনোজ একসঙ্গে–”হ্যাঁ হ্যাঁ, রাজবাড়ি।”
“মেজদা?”
সরোজ আর মনোজ–”মেজকাকা। গান গাইতে গাইতে যাচ্ছে।”
“রাজবাড়ি!” বলে হারাধন তবু ইতস্তত করে। ঠিক এ সময়ে হারাধনের পিছন থেকে কে যেন বিরক্তির গলায় বলে ওঠে, “শ্যা মশাই, রাজবাড়ি। রাজার বাড়ি, যাকে বলে ষষ্ঠীতৎপুরুষ সমাস। জলের মতো সোজা।”
সবাই অবাক হয়ে দেখে, শালিখের খাঁচার পিছন থেকে দুঃখবাবু বেরিয়ে আসছেন।
হারাধন বলে, “আপনি এখানে?”
দুঃখবাবু দুঃখের সঙ্গে বলেন, “আর কোথায় লুকোব বলুন, কিন্তু এই বদমাশ পাখিগুলোই কি লুকিয়ে থাকতে দেয়। তখন থেকে চেঁচাচ্ছে।”
“লুকিয়ে ছিলেন কেন?”
দুঃখবাবু রেগে গিয়ে বলেন, “লুকোব না? একে তো খুনি, তার ওপর পুলিশ, তিন নম্বর হনুমান, চার নম্বর এই রাতে ভজবাবুকে খুঁজতে যাওয়া। চাকরি করতে এসে তো আর প্রাণটা দিতে পারি