বৈজ্ঞানিক হারাধন এত চিন্তাকুল যে, প্রথমটায় পুতুলকে চিনতেই পারেনি। অনেকক্ষণ বাদে চিনতে পেরে বলল, “কী বলছিস?”
পুতুল তখন খাঁচাটার মধ্যে রাখা কাকটাকে একমনে দেখছে। কাকটার গলায় এখনও পৈতে জড়ানো, পায়ে একটা ঝুমঝুমির মতো কী যেন বাঁধা। খুবই চেনা কাক।
পুতুল অবাক হয়ে বলল, “আরে! এই কাকটাই তো সকালে আমাদের বাড়িতে কুরুক্ষেত্র করেছে। এটার জন্যই কত সব কাণ্ড হয়ে গেল! তুমি কাকটাকে ধরলে ছোটকাকা?”
হারাধন বিরক্ত হয়ে বলে, “ধরব কেন? এটা তো আমারই কাক। সকালে ছেড়ে দিয়েছিলাম এক্সপেরিমেন্টের জন্য। তারপর বিকেল হতেই আবার নিজে থেকে এসে খাঁচায় ঢুকেছে।”
“তোমার কাক! তোমার কাক এত বদমাশ কেন বলো তো!” হারাধন একটু বিজ্ঞের হাসি হেসে বলে, “বদমাশ হবে কেন? একটু তেজী আর কী! অন্য চার-পাঁচটা সাধারণ কাকের মতো নয়। তা সে ওর দোষ নয়, আমিই নানারকম ওষুধ আর ইলেকট্রিক চার্জ দিয়ে দিয়ে এটাকে ওরকম বানিয়েছি। এ আর কী দেখছিস! চারটে যা হনুমান বানিয়েছি না, তারা একেবারে ডাকাত। ছেড়ে দিলে লঙ্কাকাণ্ড করে আসবে।”
পুতুল হারাধনের হাত ধরে টানতে টানতে বলল, “হনুমানের কথা পরে। আগে চলো। পুলিশের সঙ্গে ঠাকুরঝির মারামারি হচ্ছে যে!”
“বলিস কী!” বলে হারাধন লাফিয়ে ওঠে।
“শুধু তাই বুঝি! পুলিস আবার মেজকাকুকে ধরে নিয়ে যেতে এসেছে। যা বিচ্ছিরি কাণ্ড না, আমার ভীষণ কান্না পাচ্ছে।”
হারাধন দুই লাফে ল্যাবরেটরি পার হয়ে উঠোনের দিকে দরজা খুলে দেখে, বাস্তবিক সারা উঠোন জুড়ে তাণ্ডব শুরু হয়েছে। পাঁচিল টপকে টপকে সব সিপাইরা উঠোনে নামছে আর ঠাকুরঝি প্রকাণ্ড লাঠি নিয়ে তাদের তাড়া করছে। কিন্তু তারা কাবাডি খেলোয়াড়ের মতো ঠাকুরঝির লাঠির নাগাল এড়িয়ে দৌড়ে লাফিয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছে চারদিকে। ঠাকুরঝি চেঁচাচ্ছেন, “ডাকাত! ডাকাত! ওরে তোরা কেন পুলিশকে খবর দিচ্ছিস না?”
ঠিক এই সময়ে অন্ধকারে সতীশ ভরদ্বাজ মশাইও উঠোনে ঢুকে পড়েছেন। তিনি বললেন, “উঁহু, এরা ডাকাত নয়, এরা হল পুলিশ। আপনি বরং ডাকাতদের ডাকুন, নইলে এ পুলিশদের ধরবে কে?”
আদ্যাসুন্দরীর তখন হুঁশ হল। তিনি একটা রোগা পুলিশের ঠ্যাঙে পটাং করে লাঠির ঘা বসিয়ে নতুন করে চেঁচাতে লাগলেন, “ওগো, তোমরা কে কোথায় আছ, শিগগির ডাকাতদের খবর দাও। আমাদের বাড়িতে পুলিশ পড়েছে।”
তখন চারদিকে আরও কয়েকজন চেঁচাল, “ওরে, শিগগির ডাকাতদের খবর দে, এবাড়িতে পুলিশ ঢুকেছে।”
হারাধন দৃশ্যটা দু মিনিট দাঁড়িয়ে দেখল। তার দুধারে পুতুল, সরোজ, মনোজ। তারপর ধীরে ধীরে ভাইপো-ভাইঝিদের হাত ধরে ঘরে টেনে এনে দরজা বন্ধ করে দিয়ে বলল, “শোন্, এখন আমি যে ব্যবস্থা করব তা কিন্তু ঘুণাক্ষরেও কাউকে বলবি না। আমার সন্দেহ হচ্ছে পুলিশের ছদ্মবেশে অন্য কোনও রাষ্ট্রের চর আমার ফরমুলা চুরি করতে এসেছে। এদের শিক্ষা দেওয়া দরকার।”
বলে হারাধন গটগট করে গিয়ে তার জীবজন্তুর ঘরে ঢুকল। সঙ্গে সরোজ, মনোজ আর পুতুল। ঘরের একেবারে কোণের দিকে চারটে বিশাল খাঁচা। সেগুলোর চারদিকে চটের পর্দা ফেলা। হারাধন গিয়ে খাঁচার পা তুলে দিল। ভিতরের দৃশ্য দেখে সরোজ মোজ আর পুতুলের চোখ ছানাবড়া। তারা তাড়াতাড়ি ছোটকাকার গা ঘেঁষে দাঁড়াল।
খাঁচার ভিতরে চারটে বিশাল চেহারার হনুমান। এত বড় হনুমান যে থাকতে পারে, তা তিন ভাইবোনের জানাই ছিল না। সরোজ প্রথমটায় বলে উঠল, “গোরিলা।”
“বনমানুষ!” পুতুল বলে ওঠে।
মনোজ বলল, “না, হনুমান। তবে বড় বড়।”
হারাধন খাঁচার দরজার তালা খুলতে খুলতে বলল, “এ হচ্ছে গোরিমান।”
“তার মানে?” সরোজ জিজ্ঞেস করে।
মনোজ ছোটকাকার ব্যাপার-স্যাপার ভালই জানে, সে তাই বলে উঠল “খানিকটা গোরিলা, খানিকটা হনুমান, না ছোটকাকা?”
“হুঁ। তবে ওষুধ দেওয়া হনুমান, আর পিটুইটারি গ্ল্যান্ডের কারসাজি। তোরা দৌড়ে গিয়ে বাড়ির লোকজনকে সব ঘরে ঢুকে যেতে বল। আমি হনুমান ছেড়ে দিচ্ছি। তারপর লঙ্কাকাণ্ড কাকে বলে তা সবাই টের পাবে।”
সরোজ, মনোজ আর পুতুল দৌড়ে গিয়ে ঠাকুরঝি, ঠাকুমা, মা, কিরমিরিয়া সবাইকে ধরে নিয়ে ঘরে ঢুকিয়ে দিতে লাগল। আর সেই সময়ে আধো অন্ধকারে অতিকায় চারটে বিভীষিকা বিভীষণ লাফ দিয়ে উঠোনে নেমে এসে পিলে চমকানো ডাক ছাড়ল “গাপ! ধর! গাপ! ধর।”
সে-ডাক শুনলে রক্ত জল হয়ে যায়, সে-চেহারা দেখলে ভিরমি খেতে হয়। কিন্তু তার চেয়েও বড় কথা হল, তারা এক একটা পুলিশকে নেংটি ইঁদুরের মতো এক-এক হাতে তুলে যখন এ-ধার ওধার ছুঁড়ে ফেলছিল, তখন তাদের এলেম দেখে সবাই তাজ্জব।
প্রথমটায় পুলিশরা ব্যাপারটা বুঝতে পারেনি। একজন আবার একটা হনুমানকে জড়িয়ে ধরে চেঁচিয়েও উঠেছিল, “এইবার খুনিকে ধরেছি।” তারপরই সে হঠাৎ তারস্বরে বলতে লাগল, “না না, এর যে লেজ রয়েছে! ও বড়বাবু, খুনির কি লেজ আছে নাকি?”
তারপরই দেখা গেল হনুমানকে জড়িয়ে ধরেছিল যে পুলিশটা, সে শুন্যপথে উড়ে পাঁচিলের ওধারে পড়ল। একজন পুলিশ গিয়ে পড়ল টিনের চালে। হনুমানদের একজন দুটো পুলিসকে দু বগলে নিয়ে মহানন্দে এক চক্কর নাচ নেচে নিল।
সতীশ ভরদ্বাজ ঘর থেকে জানালা দিয়ে দৃশ্য দেখতে দেখতে বললেন, “আদ্যাদিদির ডাকের গুণ আছে। এ যে দেখছি চার-চারটে পালোয়ান ডাকাত! না..না…ডাকাত তো নয়! সর্বনাশ! এ যে স্বয়ং রামচন্দ্রের ভক্ত। ও আদ্যাদিদি, কলিকালে দু পাতা বিজ্ঞান পড়ে ম্লেচ্ছরা ধর্ম মানতে চায় না। কিন্তু নিজের চোখে সবাই এসে দেখুক ভক্তের বিপদের সময় ভগবান তাঁর অনুচর পাঠান কিনা। ওই দেখ সবাই, দু চোখ ভরে চেয়ে দেখ, স্বয়ং রামভক্ত হনুমানেরা এসেছেন!…আহা! কী করাল বিশাল চেহারা! কী সাংঘাতিক গায়ের জোর! …জয় বাবা হনুমানের জয়!”