একটা ঝাঁকড়া চুলওলা ডাকাত আর একটার কানে গোঁজা বিড়ি নিয়ে খেয়ে ফেলেছে বলে দুজনে খুব ঝগড়া হচ্ছিল। পা-পোড়া মোটা ডাকাতটা পরিত্রাহি চেঁচাচ্ছে। ডাকাতের মেজ সর্দার সেই সুন্দরমতো ছেলেটা ভজবাবুর পিস্তল নিয়ে আমোদ করার জন্যই গোটা দুই দুমদাম গুলি ছুড়ল আকাশের দিকে।
ভজবাবুর বড় তেষ্টা পেয়েছে। গলা শুকিয়ে কাঠ। বুকটা চড়চড় করছে। প্রাণপণে বললেন, “জল!”
বিড়ি-চোর ডাকাতটা সবচেয়ে কাছে। সে ভজবাবুর দিকে মুখ ফিরিয়ে বলল, “চোপ! যার বলি হবে তার আবার অত কথা কী? আর ক মুহূর্ত পরেই সব খিদে তেষ্টা মিটে যাবে।”
ওপাশ থেকে কানাই জিজ্ঞেস করল, “কী বলছে রে বাজাড়টা?”
“জল চায়।”
কানাইয়ের মায়া হল, বলল, “দে না একটু।”
খাঁড়া হাতে লোকটা খাঁড়া নামিয়ে বলল, “ওরে, তোদর আর কতক্ষণ লাগবে। বলি দিবি বলে ফেলে রেখেছিস লোকটাকে তো দেরি করছিস কেন? লোকটার এ ভাবে পড়ে থাকতে কষ্ট হচ্ছে না?”
বিড়ি-চোর ডাকাতটি ঘটি করে জল আনছিল, সুন্দর মতো ছেলেটা চোখের ইঙ্গিতে তাকে নিষেধ করে এক গ্লাস শরবত নিয়ে গিয়ে কাছে বসে ভজবাবুকে বলল, “হাঁ করুন।”
ভজবাবু চোখ বুজে রেখে হাঁ করলেন। ডাকাতটা তাঁর মুখে খানিকটা শরবত ঢালতেই শিউরে উঠে বিষম খেলেন ভজবাবু, খানিকটা পেটে গেল, খানিকটা ফেলে দিয়ে বললেন, “এ কী রে বাবা, এ তো জল নয়।”
“জলের চেয়ে দামি জিনিস। আর একটু খান। আজকের দিনে খেতে হয়। আমরা সবাই খাচ্ছি তো।”
তেষ্টায় বুক কাঠ, না খেয়ে করেন কী ভজবাবু! আবার হাঁ করে আর একটু মুখে নিয়ে চুকচুক করে খেলেন। এবার অতটা খারাপ লাগল না। আবার খেলেন। আবার।
কিছুক্ষণ পরে চোখে ঘোর-ঘোর দেখতে লাগলেন। শরবতের মধ্যে কী ছিল কে জানে, ভজবাবুর মাথাটা কেমন যেন অন্যরকম হয়ে যেতে লাগল। ভয়ডর কেটে গিয়ে ঠাণ্ডা শরীরটা গরম হয়ে উঠতে লাগল। খুব একটা তেজ এল মনের মধ্যে। হাড়িকাঠে গলা দিয়েও হঠাৎ হুংকার ছাড়লেন, “সব ব্যাটাকে দেখে নেব! সব ব্যাটাকে দেখে নেব!”
সেই হুংকার শুনে রোগা আর ভিতু ডাকাতরা একটু দূরে সরে বসল। মেজ সর্দার ভজবাবুর মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে বলল, “এই তো চাই। এ না হলে বাপের ব্যাটা! তা ভজবাবু, আজ চলুন না আমাদের সঙ্গে ডাকাতি করতে, দেখি কেমন সাহস আপনার?”
ভজবাবু একটা ফুঃ করে বললেন, “এ আর কী কথা! এক্ষুনি চলো। কার বাড়ি লুট করবে?”
“রাজবাড়ি।”
“আরে দূর দূর। রাজবাড়িতে আছে কী? আছে একটা খুঁটের পাহাড় আর নটে শাকের জঙ্গল। রাজাদের কি আর সেই দিন আছে! লুটবে তো চলো একটা ব্যাঙ্ক লুট করি।”
“না। আমরা আজ রাজবাড়ি লুট করব ঠিক করেছি। সেখানে মাটির নীচে অনেক টাকা আছে। ভয় পাবেন না তো ভজবাবু?”
ভজবাবু হাড়িকাঠে শুয়ে থেকেই খুব হেঃ হোঃ করে হেসে বললেন, “ভজহরি কখনও ভয় কাকে বলে জানে না। হাড়িকাঠের খিলটা খুলে আমার হাতে একটা পিস্তল দাও, তোমাদের দেখিয়ে দিচ্ছি।”
মেজো সর্দার বলল, “আমরা পিস্তল বন্দুক রাখি না। বড় সদারের একটা বন্দুক আছে, কিন্তু তার আজ বড় আমাশা হয়েছে বলে সে যাচ্ছে না। আর আপনার এ পিস্তলেও আর গুলি নেই।”
“ছ্যাঃ ছ্যাঃ কেমন ডাকাত হে তোমরা যে পিস্তলবন্দুক রাখো। ঠিক আছে, দারোগাবাবুকে বলে আমি তোমাদের পিস্তলের বন্দোবস্ত করে দেব। আমাকে আজকের মতো একটা রাম দা-ই দাও, কী আর করা!”
মেজ সদর হাড়িকাঠের খিল খুলে দিতেই ভজবাবু লাফিয়ে উঠে দাঁড়ালেন। চেঁচিয়ে বললেন, “অ্যাটেনশন।”
সেই চেঁচানিতে ডাকাতরা আবার ভয় খেয়ে চমকে উঠল। মেজ সর্দার হেসে বলল, “তোরা সব সোজা হয়ে দাঁড়া। আজ ভজবাবুই আমাদের সর্দার।”
ভজুবাবুও মাথা নেড়ে বললেন, “আলবাত আমি সর্দার। এই কানাই, রামদা দে একটা।”
কানাই ভয়ে ভয়ে একটানা রামদা এগিয়ে দিতেই ভজবাবু সেটা হাতে নিয়ে তিন চারটে লাফ মেরে বাঁই বাঁই করে ঘোরালেন চারদিকে। তারপর একগাল হেসে বললেন, “দেখলে তো সবাই।”
সবাই তারিখ করে বলল, “বাঃ। বহুত খুব!”
ভজবাবু গম্ভীর হয়ে বললেন, “এক বাটি মাংস নিয়ে আয়।”
বিড়ি-চোর এক বাটি ভর্তি মাংস নিয়ে এল। ভজবাবু রামদা পাশে নিয়ে বসে বললেন, “তোরাও বসে যা। রাতে অনেক কাজ আছে।”
আদ্যাসুন্দরী দেবী এক হাতে লাঠি আর এক হাতে গুলতি নিয়ে উঠোনে ঢুকবার দরজা আটকে দাঁড়িয়ে রক্ত-জলকরা গলায় হেঁকে বললেন, “দ্যাখো বাবা দারোগা, ভাল চাও তো বাড়িতে ঢুকবার আগে তোমার সেপাইদের জুতো খুলতে বলল, আর তুমিও খোলো। জুতো পরে যে ঢুকবে, তার আমি রক্ষে রাখব না।”
নিশি দারোগা গম্ভীর হয়ে বললেন, “ডিউটির সময়ে আমাদের জুতো খুলবার আইন নেই পিসিমা, আমাদের কাছে ব্যাঘাত সৃষ্টি করবেন না। মারাত্মক খুনিকে ধরতে এসেছি আমরা, ইয়ার্কির সময় নেই।”
আদ্যাসুন্দরীদেবী জীবনে কাউকে ভয় করেননি। গত বছরও গ্রীষ্মকালে একটা চোর জানালা দিয়ে গেঞ্জি চুরি করার চেষ্টা করেছিল বলে আদ্যাসুন্দরী হাত বাড়িয়ে তার কান মলে দেন। তা ছাড়া গুলতিতে তাঁর হাতের টিপের কথাও সবাই জানে। ব্রত-পার্বণে আম্রপল্লব বেলপাতা দরকার হলে তিনি নিজেই গাছে গুলতি মেরে-মেরে আমপাতা বেলপাতা পেড়ে আনেন। কাজেই আদ্যাসুন্দরী দেবীকে যারা জানে, তারা চট করে এ বাড়িতে ঢোকে না, একটু চিন্তা করে ঢোকে।