গণেশবাবু চিচি করে বললেন, “বন্দুক নয়, তানপুরা।”
“তানপুরাই ফেলুন।”
এ সময়ে রাখোবাবু বেরিয়ে এসে বললেন, “এসব কী। কী হয়েছে নিশিবাবু?”
নিশিকান্ত অত্যন্ত গম্ভীরমুখে বললেন, “আপনার ভাই ভজহরিবাবুর নামে ওয়ারেন্ট আছে।”
“ওয়ারেন্ট মানে? কিসের ওয়ারেন্ট?”
এই শীতেও নিশিকান্ত কপালের ঘাম মুছে বললেন, “একজন মার্ডারারকে ঘরে লুকিয়ে রেখে আর ভান করবেন না রাখোবাবু। দয়া করে ওঁর পিস্তলটা কেড়ে নিয়ে হাত দুটো ভাল করে বেঁধে আমাদের কাছে এনে দিন।”
“কার পিস্তল? কে মার্ডারার? কাকে বাঁধব?”
নিশিকান্ত খুব বিজ্ঞের হাসি হেসে বললেন, “সবই তো জানেন রাখোবাবু, কেন অভিনয় করছেন? ভজবাবু যে এত বড় মার্ডারার তা যদি আগে জানতাম। ভদ্রবেশে এত বড় খুনি এতদিন ঘুরে বেড়াচ্ছিল কেউ টেরই পায়নি। কত দারোগাই তো এ শহরে এর আগে এসেছে, কেউ ধরতেও পারেনি। কিন্তু এবার ভজবাবুর খেলা শেষ। আমার হাতেই আজ এত বড় রহস্যের কিনারা হয়ে যাবে। কই, নিয়ে আসুন তাকে! সাবধান, যখন আনবেন তখন যেন পিস্তলটা হাতে না থাকে।”
রাখোবাবু আকাশ থেকে পড়ে বললেন, “ভজু মার্ডারার?”
পিছন থেকে আদ্যাসুন্দরী বলে উঠলেন, “এ দারোগাটাকে পেত্নীতে পেয়েছে।”
ঠাকুমা কেঁদে উঠে বললেন, “বন্দুক পিস্তল দূরে থাক বাবা, আমার ভজু দা দিয়ে বাঁশ পর্যন্ত কাটে না, পাছে বাঁশ ব্যথা পায়।”
কিরমিরিয়া দারোগা পুলিশ দেখে বিলাপ করে কাঁদছিল, “ওগো, আমাকে ধরে নিয়ে যেও না গো। আমি কালই মুলুকমে চলে যাব গো। ভজবাবু কেন পিস্তল দিয়ে খুন করল গো!”
“চুপ কর তো কিরমিরিয়া!” বলে রাখোবাবু ধমক দিলেন।
গণেশবাবু তানপুরাসুদু হাত ওপরে তুলে দাঁড়িয়ে ছিলেন, হঠাৎ বলে উঠলেন, “হাত দুটো কি নামাব দারোগাবাবু?”
দুঃখবাবু পড়ার ঘরের দরজায় খিল এঁটে জানালা দিয়ে দৃশ্যটা দেখেছেন। তাঁর পাশে সরোজ, মনোজ, পুতুল।
সরোজ বলল, “পিস্তল?”
মনোজ বলল, “পিস্তল।”
পুতুল বলল, “পুতুলের বাক্সে ছিল।”
দুঃখবাবু ধমক দিয়ে বললেন, “আঃ, গোল কোরো না। ইম্পট্যান্ট কথা হচ্ছে সব, শুনতে দাও।”
গোলযোগ শুনে পাড়ার লোকও এসে জড়ো হয়েছে কম নয়। তবে তারা একটু দূরে দূরে।
নিশিকান্ত গম্ভীর গলায় বললেন, “শুনুন রাখোবাবু, আসল অপরাধীকে কোনওদিন বাইরে থেকে চেনা যায় না। আমাদের ক্রিমিনোলজিতে দেখবেন, বেশির ভাগ অপরাধীই দেখতে এবং আচরণে অতি নিরীহ। আর এদের অপরাধ প্রবণতা অনেক নিকট আত্মীয়স্বজনও টের পায় না। কাজেই ভজবাবুকে আপনারা যত নির্দোষ ভেবে এসেছেন ততটা মোটেই নয়। এ শহরের অন্তত দশ বারোজন লোক ভজবাবুর শিকার হয়েছেন। প্রত্যেকেই অল্পের জন্য বেঁচে যান। এমন কী, আমার একটা সেপাইকে পর্যন্ত তিনি দশবার ওঠবোস করিয়েছেন। আর কী করেননি শুনি। হরশঙ্কর গয়লাকে প্রায় মেরে ফেলেছিলেন, সে হাতে পায়ে ধরে বেঁচে যায়। ইউরোপিয়ান ক্লাবে গিয়ে গুলি ছুঁড়েছেন, গোবিন্দবাবু আর শার্দুলবাবুকে আধমরা করেছেন, বাজারে গিয়েছিলেন কাকে যেন তাক করতে। সবাই এসে থানায় রিপোর্ট করেছে। আমরা ইয়ার্কি করতে আসিনি রাখোবাবু। বাড়ি ঘেরাও করা হয়েছে, ভজবাবুকে বের করে দিন।”
রামু এতক্ষণ বারান্দায় শুয়ে ঘুমোচ্ছিল। চেঁচামেচি শুনে উঠে এসে বলল, “ভজবাবু? ভজবাবু তো সেই সঝাবেলা পিস্তল নিয়ে বেরিয়ে গেলেন। বললেন কী, আজ সব গুণ্ডা বদমাশ আর খারাপ লোককে ঢিট করে আসবেন।”
রাখোবাবু ধমক দিয়ে বললেন, “তা সেটা এতক্ষণ বলিসনি কেন?”
রামু কাঁচুমাচু হয়ে বলে, “বলার ইচ্ছা ছিল, কিন্তু হরশঙ্কর পাহলোয়ান আমাকে এমন ঘিসা দিল কি আমার তবিয়ত খারাপ হয়ে গেল।”
দারোগাবাবু গম্ভীর হয়ে বললেন, “রাখোবাবু এ লোকটার নামই কি রামু?”
“হ্যাঁ।”
“তা হলে এর নামেও একটা মোষ চুরির নালিশ আছে। এ আজ হরশঙ্করের একটা দুধেল মোষ চুরি করে এনে আপনাদের গোয়ালে বেঁধে রেখেছিল।”
এই বলে দারোগাবাবু তাঁর সিপাইদের দিকে ফিরে বললেন, “লোকটাকে আগে সার্চ করে দেখ আর্মস আছে কিনা। তারপর অ্যারেস্ট করো।”
শুনে রামু সটান মাটিতে শুয়ে চেঁচাতে থাকে, “হনুমানজিকে কিরিয়া হো পুলিশ সাহেব, চোরি আমি কভি করি না।”
নিশিকান্ত সে কান্নায় কর্ণপাত করলেন না। রাখোবাবুর দিকে চেয়ে বললেন, “ভজবাবু বাড়িতে নেই বলছেন?”
রাখোহরিবাবু গম্ভীর হয়ে বললেন, “কথায় বিশ্বাস না হয় খুঁজে দেখতে পারেন।”
“সে তো দেখতেই হবে। তবে আমার ভয় হচ্ছে, এখনো যদি ফিরে থাকেন তবে এর মধ্যে নিশ্চয়ই অন্য কোথাও আরো কয়েকজনকে খুন করেছেন বা করছেন ভজবাবু।”
ঠাকুমা ডুকরে উঠে বলেন, “না না, সে যে মশা মারতে মায়া করে।”
ঠাকুরঝি পরিষ্কার গলায় বললেন, “দ্যাখো বাবা দারোগা, সার্চ করার সময় জুতো পরে ঘরে ঢুকতে পারবে না বলে দিচ্ছি। তোমার সেপাইদেরও জুতো খুলতে বলল। এই রাতে গোবরছড়া দিয়ে মরব নাকি, সে হবে না।”
.
এদিকে তখন ডাকাতে কালীবাড়িতে ভজবাবু হাড়িকাঠে পড়ে আছেন। একটা জোয়ান ডাকাত রামদা হাতে দাঁড়িয়ে। বাজনদাররা বলির বাজনা বাজাচ্ছে। দৃশ্যটা সহ্য করতে পারছেন না ভজবাবু। কয়েকবার অজ্ঞান হয়ে যাওয়ার চেষ্টা করলেন। কিন্তু ইচ্ছে করে যে অজ্ঞান হওয়া যায় না সেটা বুঝে মা কালীকে ডাকতে লাগলেন। একমনে বলতে লাগলেন, “আমাকে অজ্ঞান করে দাও মা।”