কানাই দায়ে ধার দিচ্ছিল, আচমকা ভজবাবুর মূর্তি আর পিস্তলের শব্দে সে মনে করল, পুলিশ এসেছে। সে হাঁটু গেড়ে বসে খুব অভিমানের সুরে হাতজোড় করে বলতে লাগল, “এসব কি ঠিক হচ্ছে পুলিশ সাহেবদের? আজ সকালেই দু সের বড় বড় কই মাছ দারোগাবাবুদের বাড়িতে পৌঁছে দিয়ে এসেছি, তবু এই মন্দিরে এসে জুলুম কেন? নিরালায় বসে কয়েকজন ভক্ত মায়ের পুজো করছে, তার মধ্যে এসে এই হুজ্জতের কোনও মানে হয়?”
কিন্তু ভজবাবুর কানে সেসব কথা যাচ্ছে না। ডাকাতদের পালাতে দেখে তাঁর সাহস দ্বিগুণ বেড়ে গেল। সোল্লাসে লাফাতে লাফাতে বলতে লাগলেন, “সব ব্যাটাকে মেরে ফেলব। খুন করব। তারপর ফাঁসিতে ঝোলাব। আজ তোদেরই একদিন কি আমারই একদিন।”
তারপর হঠাৎ কানাইকে দেখতে পেয়ে ভজবাবু এক লাফে তার সামনে এসে নাকের ডগায় পিস্তলের নল ঠেকিয়ে বললেন, “কানাই!”
ভজবাবুকে দেখে কানাই অবাক। পিস্তল দেখে আরো অবাক। কাঁপা গলায় বললেন, “আজ্ঞে!”
“এবার?” ভজবাবু একগাল হেসে বললেন।
কানাই কাঁপা গলায় বলে, “রোজ তো আপনাকে নিজের ক্ষতি করে কম দামে মাছ দিই ভজবাবু!”
“আজ সকালে যে বড় কৈ মাছগুলো লুকিয়েছিলি।”
“পরে তো বের করে দিচ্ছিলাম ভজবাবু, কেবল গোয়েন্দাচরণ
এসে–”
“চোপ,” বলে ভজবাবু এক ধমক দিয়ে বললেন, “বেশি কথা বলতে হবে না। দশবার ওঠবোস কর। তাড়াতাড়ি।”
কানাই খুব বাধ্য ছেলের মতো ওঠবোস করতে যাচ্ছিল। কিন্তু তার আর দরকার হল না। কোথা থেকে একটা মাছ ধরার জাল উড়ে এসে ভজবাবুকে আপাদমস্তক মুড়ে ফেলল। হ্যাঁচকা টান খেয়ে ভজবাবু চাতালে গড়াগড়ি।
মাছের জালের দড়িটা হাতে নিয়ে ডাকাতের মেজ সর্দার সেই সুন্দরপানা ছেলেটা চেঁচিয়ে বলল, “ওরে, তোরা সবাই আয় রে। লোকটাকে ধরেছি। আজ বড় করে পুজো হবে ফের। আর সেই পুজোতে নরবলি হবে।”
সেই শুনে ভজবাবু মূর্ছা গেলেন। যতক্ষণ হাতে পিস্তল ছিল ততক্ষণ ভজবাবু আর ভজবাবু ছিলেন না, মহাবীর হয়ে গিয়েছিলেন। যেই পিস্তলটা হাত থেকে ছিটকে গেল অমনি তিনি রোজকার ভিতু, নিরীহ, গোবেচারা ভজহরি হয়ে গেছেন।
মুর্ছা যখন ভাঙল তখন দৃশ্য ভজবাবুর আবার মূর্ছা যাওয়ার উপক্রম। দেখেন ডাকাতরা আবার সব জমায়েত হয়েছে। চারদিকে মহা উল্লাস চলছে। তিনি টের পেলেন তাঁর হাত পিছমোড়া করে বাঁধা, গলাটা হাড়িকাঠে আটকানো। ঢাক আর কাঁসিতে কারা যেন বলির বাজনা বাজাচ্ছে। কানাই মাছওলা বলছে, ‘এই ছ্যাঁচড়া বাজাড়টার জন্য আর মাছ বেচে সুখ ছিল না। আজ এটাকে নিকেশ করতেই হবে।’
রোগা পুরুতমশাই এসে ভয়ে কাঁপতে কাঁপতে ভজবাবুর কপালে একটা সিঁদুরের তিলক এঁকে দিলেন। ডাকাতরা চেঁচাল, ‘জয় মা জয় মা!’
৫. মনোজদের বাড়ির অবস্থা বেশ থমথমে
বেশ রাত হয়েছে।
মনোজদের বাড়ির অবস্থা বেশ থমথমে। হারানো ছবিটা পাওয়া যায়নি বলে রাখোবাবু প্রচণ্ড রেগে গিয়েছিলেন বটে, কিন্তু সন্ধেবেলার পর যেসব খবর এসেছে তাতে তাঁর রাগ জল হয়ে প্রচণ্ড ভয় ঢুকে গেছে।
প্রথমেই থানা থেকে একদল সেপাই নিয়ে দারোগা নিশিকান্ত এসে হাজির। নিশিকান্ত ভারী কড়া দারোগা, একবার তাঁর দুই ছেলে মারপিট করে একজন অন্যজনের মাথা ফাটিয়েছিল বলে তাদের দুদিন করে হাজতবাস করিয়েছিলেন। আর একবার তাঁর স্ত্রী রাগ করে বাপের বাড়ি যাওয়ায় স্ত্রীর নামে ওয়ারেন্ট বের করেন। শুধু অন্যের বেলাতেই নয়, নিজের বেলাতেও তিনি সমান কড়া। যদি চোর ডাকাত ধরতে না পারেন, কোনও অপরাধের যদি কিনারা না হয় তবে তিনি নিজে নাকে খত দেন, উপপাস করেন, কখনও বা সেপাইকে ডেকে বলেন–আমাকে দশ ঘা বেত মার তো! ভারী কালীভক্ত লোক। যদি কেউ নিশি দারোগাকে কালীর গান শোনায় তবে তাঁর ভর হয়। চিতপাত হয়ে পড়ে গোঁ-গোঁ করে মুখে গাঁজলা তোলেন। নিশি দারোগাকে সবাই তাই সমঝে চলে।
সন্ধেবেলা এসেই তিনি বাইরে থেকে হাঁক ছাড়লেন, “ভজবাবু, আমরা বাড়ি ঘিরে ফেলেছি, পালাবার চেষ্টা করবেন না বা গুলি ছুঁড়বেন না। যদি গুলি ছোঁড়েন তবে আমরাও ছুঁড়ব। যদি পালান তো আমরাও পালাব–থুড়ি আমরা আপনাকে ধাওয়া করে ধরে ফেলব। কোন চালাকি করার চেষ্টা করবেন না।”
এমনিতে নিশিকান্ত যতই কড়া হোন না কেন, লোকে বলে তিনি ভারী ভিতু লোক। ঘুষ নেন না বটে তবে ঘুষিও চালান না। গুলিটুলি চালাতেও তাঁর অনিচ্ছে ভীষণ। চোর-ডাকাতদের পিছু নেওয়া বা বিপজ্জনক লোককে গিয়ে ধরা-টরার কাজেও তিনি নেই।
তবু তাঁর হাঁক-ডাক শুনে বাড়ির লোক সব হন্তদন্ত হয়ে বেরোল।
দুঃখবাবু মনোজ, সরোজ আর পুতুলকে পড়াচ্ছিলেন। গণেশবাবু একমনে একটা তান ধরেছেন। পুলিশের বুটের আওয়াজ আর গলার দাপট শুনে দুঃখবাবু তাড়াতাড়ি উঠে সরোজ, মনোজ আর পুতুলকে বললেন, “চলো ভিতরবাড়িতে যাই। এখানটায় গরম হচ্ছে।”
গণেশবাবুরও সুরটা কেটে গেল। বাড়িতে পুলিশ এসেছে টের পেয়ে তিনি তানপুরাটা বগলে নিয়ে তাড়াতাড়ি বেরিয়ে পড়লেন। ইচ্ছে, পালিয়ে যান। কিন্তু বেরোতেই বাগানের ফটক থেকে একেবারে মুখের ওপর একটা টর্চের আলো এসে পড়ল। সেই আলোতে একটা রাইফেলের নল বা পুলিশের লাঠি যাহোক একটা বস্তুও দেখা গেল। নিশি দারোগা হুংকার ছাড়লেন, “বন্দুক ফেলে দিয়ে হাত তুলুন।”