চোট্টা গোবিন্দ প্রায় কেঁদে ফেলে বলে উঠল, “আটটা পনেরো মিনিট উনচল্লিশ সেকেন্ড গতে অমৃতযোগ লাগবে। বাবা ভজু, ততক্ষণ বসে না হয় বিশ্রাম করো। বসেবসে গালাগাল করো। খানিক শুনি। বেশ বলছিলে বাবা।”
ভজবাবু রেগে গিয়ে বললেন, “কথা কানে যাচ্ছে না নাকি? ওঠবোস করতে বলছি যে!”
“ওঠবোস!” চোট্টা গোবিন্দ ভারী বিমর্ষ গলায় বলে, “ওঠবোস করব সেই ভাগ্য কি আমার আছে বাপ! দু হাঁটুতে বাত। একবার বসলে আর উঠতে পারি না, ধরে তুলতে হয়। দশবার ওঠবোস করতে একটা বেলা চলে যাবে। তাও যদি তোমরা ধরাধরি করে করাও।”
ওদিকে শার্দুল শেষবার ওঠবোস করে দাঁড়িয়ে হাসিমুখে বলল, “দশ। এবার ছুটি তো ভজু?”
ভজবাবু মাথা নেড়ে বলেন, “ছুটির দেরি আছে। গোবিন্দবাবু, আপনার কাছে তামা-তুলসী-গঙ্গাজল থাকে বলে শুনেছি। সেসব বের করুন।”
চোট্টা গোবিন্দ মাথা নেড়ে বলে, “থাকে বাবা। যারা ধারকর্জ করতে আসে তাদের তামা-তুলসী-গঙ্গাজল ছুঁইয়ে শপথ করিয়ে নিই যাতে সুদ ঠিকমতো দেয়, মামলা-মোকদ্দমা না করে শাপশাপান্ত না দেয়।”
পিস্তল নাচিয়ে ভজবাবু বললেন, “সেসব বের করুন। আজ আপনাদের শপথ করিয়ে নেব।”
কাঠের আলমারি খুলে চোট্টা গোবিন্দ তাপাত্রে গঙ্গাজল আর তুলসীপাতা বের করে হাতে নিয়ে দাঁড়াল। ভজবাবুর পিস্তলের ইশারায় শার্দুল চৌধুরীও তাম্রপাত্রটি ছুঁয়ে দাঁড়াল।
ভজবাবু বললেন, “এবার বলুন, আর কখনও টাকা ধার দিয়া সুদ লইব না, বন্ধকের কারবার করিব না, মানুষের সর্বনাশ করিয়া ধনী হইব না—”
চোট্টা গোবিন্দ বলতে থাকে, সঙ্গে সঙ্গে শার্দুলও বলে, “আর কখনও টাকা ধার দিয়া সুদ লইব না, বন্ধকের কারবার–”
ভজবাবু বিরক্ত হয়ে শার্দূলকে বলেন, “আহা, ও কথা আপনার বলবার নয়। আপনার শপথবাক্য আলাদা।”
এরপর ভজবাবু শার্দুলকে দিয়ে শপথ করাতে থাকেন, “আর কখনও বেহিসাবি খরচ করিব না, ফুর্তি করিয়া টাকা উড়াইব না, আর বাজার করিতে গিয়া দরাদরি না করিয়া জিনিস কিনিব না–”
এবার শার্দুলের সঙ্গে সেসব কথা চোট্টা গোবিন্দও বলতে থাকে, “আর কখনও বেহিসাবি খরচ করিব না, ফুর্তি করিয়া টাকা উড়াইব না, আর বাজার করিতে গিয়া”।
ভজবাবু চোট্টা গোবিন্দকে ধমক দিলেন, “ওসব আপনাকে কে বলতে বলেছে? আপনি বরং সুদের কারবার ছেড়ে এবার থেকে ফুর্তি করেই টাকা ওড়াবেন। আপনার সেইটেই দরকার।”
“তাই করব বাবা। তবে বুড়ো বয়সে কিছু মনে থাকে না। যা সব শপথ করালে তা মনে থাকলে হয়।”
ভজবাবু একটু তৃপ্তির হাসি হেসে বেরিয়ে এলেন। এবার যাবেন বাজারে। কানাই মাছওলাকে ঢিট করতে না পারলে সুখ নেই।
কিন্তু বৈকালী বাজারে আজ কানাই বসেনি। মেছুনী অনঙ্গবালা ভজবাবুকে চুপি চুপি বলল, “আসবে কী করে বাবু, আজ যে কানাইয়ের কালীপুজো।”
“কালীপুজো! কালীপুজো তো কবে হয়ে গেছে।”
অনঙ্গবালা পান-খাওয়া মুখে একটু হেসে বলে, “সে পুজো নয় বাবু। আপনাকে বলেই বলছি, আজকের পুজো হচ্ছে ডাকাতি করার পুজো।”
“বটে!” ভজবাবুর মুখখানা অসুরের মুখের মতো হয়ে গেল। বাজার থেকে বেরিয়ে তিনি সোজা শহরের উত্তরদিকে যাওয়ার রাস্তায় পড়লেন। বেগে হাঁটছেন আর আপনমনে মাঝে মাঝে বলছেন, “বটে! বটে! বটে! বটে!”
বাঁশঝোঁপের আড়াল থেকে ভজ বাজাড় সবই দেখলেন, শুনলেন। তারপর আপনমনে বলে উঠলেন “বটে।”
আলোয়ানের তলা থেকে পিস্তলটা বের করে একটু আদর করলেন অস্ত্রটাকে। পিস্তল থাকলে আর কোনও ভয় নেই। পিস্তলের সামনে সব ডাকাত, বদমাশ, চোর, গুণ্ডা ঠাণ্ডা।
ওদিকে ডাকতরা খুব চিল্লামিল্লি করছে। তাদের আনন্দ আর ধরে না। পুজো হয়ে গেছে। বলির পাঁঠা কাটাকুটি করে মস্ত কড়াইতে কাঠের জ্বালে রান্না চেপে গেছে। গোটা পঁচিশ মশাল জ্বলছে চারধারে। চারদিকটা আলোয় আলো।
এদিকে মাংসের গন্ধে ভজবাবুর হঠাৎ মনে পড়ে গেল, আজ সেই দুপুরের পর এ পর্যন্ত তাঁর কিছুই খাওয়া হয়নি। বড্ড খিদে পেয়ে গেছে। তার ওপর বাঁশঝাড় থেকে হাজার হাজার মশা পিন্ পিন্ করে উড়ে এসে ঘেঁকে ধরেছে তাঁকে।
ইচ্ছে ছিল ডাকাতদের ওপর আরো কিছুক্ষণ নজর রাখবেন। ওরা যখন ডাকাতিতে বেরোবে ঠিক তখন গিয়ে যমের মত পিস্তল হাতে মুখোমুখি হবেন। কিন্তু খিদে আর মশার জ্বালায় ভজবাবু বসে থাকতে পারলেন না। আহাম্মক মশাগুলো তো পিস্তলের মর্ম বোঝে না যে ভয় পাবে। তাই ভজবাবু ভাবলেন তাড়াতাড়ি ডাকাতগুলোকে শিক্ষা দিয়ে বাড়ি ফিরে গিয়ে পেট ভরে ভাত খাবেন। সারাদিন ভারী ধকল গেছে।
এই ভেবে ভজবাবু ব্যাপারটা ভাল করে জড়িয়ে নিয়ে পিস্তল বাগিয়ে ধরে বাঘের গলায় ‘খবরদার! খবরদার!’ বলে চেঁচাতে চেঁচাতে চার-পাঁচ লাফ দিয়ে কালীবাড়ির চাতালে পড়লেন। তারপরই গুড়ম করে একটা গুলি আকাশে ছুঁড়ে বললেন, “হ্যান্ডস আপ। সবাই হাত তোলো।”
ভজবাবুর সেই চেঁচানি আর গুলির শব্দে ডাকাতদের মধ্যে প্রথমটায় এক প্রচণ্ড আতঙ্ক দেখা দিল। ভড়কে গিয়ে সবাই এদিকে সেদিক পাঁই-পাঁই করে পালাতে লাগল। একটা মোটা ডাকাত মাংসের ঝোল হাতায় তুলে নুনঝাল পরীক্ষা করছিল সে তাড়াহুড়োয় পালাতে গিয়ে সেই ফুটন্ত ঝোল হাতা থেকে মুখে ঢেলে গরমে মাংসের কড়াইয়ের জ্ঞানশূন্য হয়ে দৌড়তে গিয়ে ফুটন্ত মাংসের কড়াইয়ের মধ্যে একটা পা ডুবিয়ে দিল। তারপর ‘বাবা রে গেছি রে’ বলে লেংচে লেংচে খানিক দূরে গিয়ে পড়ল।