বলতে না পারলে তাচ্ছিল্যের হাসি হেসে বলেন, “তোকে গাধা বললে গাধাদের অপমান করা হয়।”
গোলোকবাবুর এই অসহ্য মাস্টারি ভজবাবু বহুকাল সহ্য করেছেন। এই বুড়ো বয়সেও ভজবাবুকে রাস্তায়-ঘাটে বাজারে সর্বত্র ওই গোলোকবাবু এইভাবে অপমান করে বেড়ান। তাই পারতপক্ষে গোলোকবাবুর মুখোমুখি পড়ে যেতে চান না ভজবাবু।
আজ পিস্তল হাতে পেয়েই প্রথম তাঁর গোলোকবাবুর কথা মনে পড়ল। ওই লোকটাকে টিট করতে না পারলে জীবনে শান্তি, সুখ, স্বাস্থ্য কিচ্ছু নেই।
র্যাপারের মধ্যে পিস্তল লুকিয়ে নিয়ে ভজবাবু তাই সোজা আজ বিকেলে গিয়েছিলেন গোলোকবাবুর কদমতলার বাড়িতে।
গোলোক স্যার তাঁর বাইরের ঘরে বিশাল চৌকির ওপর কম্বলমুড়ি দিয়ে বসা। সামনে খোলা একখানা পাঁচসেরী এনসাইক্লোপিডিয়া। বিনা চশমায় খুদে-খুদে অক্ষর দিব্যি পড়ে যাচ্ছেন এই অষ্টাশি বছর বয়সেও।
ভজবাবু দরজার চৌকাঠে দাঁড়াতেই তিনি মুখ তুলে দেখে বললেন, “ভজু নাকি রে?”
সেই কণ্ঠস্বরে হাতে পিস্তল থাকা সত্ত্বেও ভজবাবুর বুকটা কেঁপে গেল। বললেন, “আজ্ঞে।”
অভ্যাসবশে কম্বলের ভিতর থেকে হেড স্যার একজোড়া পা বার করে দিয়ে বললেন, “পেন্নাম তাড়াতাড়ি সেরে নে, ঠাণ্ডায় জমে যাচ্ছি।”
শহর ভরে গোলোকবাবুর ছাত্র। বুড়ো ধুড়ো, ছেলে, ছোঁকরা মিলে বিশাল ছাত্রের ব্যাটেলিয়ান। সারাদিন তাদের সঙ্গে গোলোকবাবুর দেখা হচ্ছে আর টপাটপ প্রণাম পাচ্ছেন। প্রণাম পাওয়ার এই অভ্যাসবশেই পা বের করে ফেলেছেন তিনি।
কিন্তু আজ প্রণাম করতে আসেননি ভজবাবু। তাঁর উদ্দেশ্য গোলোকবাবুর যেখানে-সেখানে মাস্টারি করার অভ্যাসটাকে বন্ধ করে দেওয়া। কিন্তু ব্যাপারের তলায় পিস্তলটা হাতের চেটোয় ঘেমে উঠল ভয়ে। গোলোকবাবু তাকিয়ে আছেন চোখে-চোখে।
ডান হাত থেকে পিস্তলটা বাঁ হাতে চালান করে প্রণামটা সেরে নেবেন বলে ভেবেছিলেন ভজবাবু। কিন্তু একটা মুশকিল হল র্যাপারের তলায় হাত-চালাচালি করতে গিয়ে দেখেন মাঝখানে র্যাপারের একটা পল্লা এসে যাচ্ছে। পিস্তলটা হাত বদল করা যাচ্ছে না। অথচ প্রণামে দেরি করাও চলে না। গোলোকবাবুর পায়ে ঠাণ্ডা লাগছে।
অগত্যা ভজবাবু ডান হাতেই পিস্তলটা ধরে রেখে বাঁ হাতে গোলোকবাবুর পায়ের ধুলো নিলেন।
গোলোকবাবু একগাল হেসে বললেন, “আমি বরাবর লোককে বলি ভজু গর্দভটার ডান বাঁ জ্ঞান নেই, তা এখন দেখছি বয়স হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে আমার সব কটা ফোরকাস্ট তোর জীবনে মিলে যাচ্ছে। বলি, তুই সব্যসাচী হলি কবে থেকে যে, বাঁ হাতে পায়ের ধুলো নিচ্ছিস?”
ভজুবাবু মাথা চুলকে বললেন, “ডান হাতে ব্যথা স্যার।”
“ব্যথা? কেন, ঢিল ছুঁড়তে গিয়েছিলি নাকি?”
“আজ্ঞে না।”
“বল দেখি, সব্যসাচী মানে কী?”
“যার দুই হাত সমানে চলে।” টপ করে বলে দিলেন ভজবাবু। আর বলে তাঁর খুব আনন্দ হল। গোলোকবাবুর বিদখুটে সব প্রশ্নের মধ্যে খুব অল্পেরই ঠিক জবাব দিতে পেরেছেন তিনি।
“বটে?” গোলোকবাবু খুব মিষ্টি করে হেসে বললেন, “এবার তা হলে বল, সব্যসাচীর ইংরাজিটা কী হবে?”
ভজবাবুর একগালে মাছি। হাতের পিস্তলটার কথা আর মনেও পড়ল না। ভয়ে পেটের ভিতরে গোঁতলান দিচ্ছে।
“স্টুপিড।” বলে গর্জন করে উঠলেন গোলোকবাবু। ধপাস করে বইটা বন্ধ করে বললেন, “বুড়ো হতে চললি, এখনও এই সব রপ্ত হল না? গোলোক মাস্টারের ছাত্র বলে সমাজে কী করে পরিচয় দিস তোরা, অ্যাাঁ? কত জুয়েল ছেলে এই হাত দিয়ে বেরিয়েছে জানিস? ওঠবোস কর। কর ওঠবোস।”
ভজবাবুর হাঁ আরও দু ইঞ্চি বেড়ে আলজিভ দেখা যেতে লাগল। নিজের কানকে বিশ্বাস করতে পারছেন না। গোলোক স্যার তাকে ওঠবোস করতে বলছেন। অ্যাঁ।
“ওঠবোস করব স্যার?” অতিকষ্টে জিজ্ঞেস করেন ভজবাবু।
“তা নয় তো কি ডন-বৈঠক করতে বলেছি। দশবার ওঠবোস করে তারপর ছুটি পাবি। শুরু করে দে।”
“হাঁটুতে বাত যে স্যার।”
“বাত সেরে যাবে।”
“হাড়ে মটমট শব্দ হয়।”
“হোক শব্দ, তাতে তোর শব্দরূপ ধাতস্থ হবে।”
“আমার যে পঞ্চান্ন বছর প্রায় বয়স হল স্যার।”
“শিক্ষার আবার বয়স কী রে উল্লুক? কর ওঠবোস। বাঁ হাতে পেন্নাম করা তোমার বের করছি। কর ওঠবোস!” গোলোকবাবু একটা হুঙ্কার ছাড়লেন।
সেই হুঙ্কারে ভজবাবু কুঁকড়ে যেন ক্লাশ সিক্স-এর ভজু হয়ে গেলেন। তারপর বাতব্যাধি ভুলে, বয়স উপেক্ষা করে, হাড়ের মটমট শব্দ তুচ্ছ করে দশবার তাঁকে ওঠবোস করতে হয়েছে।
শাস্তির দৃশ্যটা খুব আয়েস করে দেখলেন গোলোকবাবু। শুধু তিনিই নন, ভজবাবু ওঠবোস শুরু করার মুখে গোলোক স্যারের দুই নাতি আর এক নাতনিও এসে দরজায় দাঁড়াল। তাদের সে কী মুখচাপা দিয়ে হাসি!
দশবার ওঠবোস করার পর ভজবাবু যখন হ্যাঁ-হত্যা করে হাঁফাচ্ছেন তখন গোলোকবাবু বললেন, “যা। আর কক্ষনো যেন ডানবাঁ ভুল না হয় দেখিস।”
সেই অপমানের পর বেরিয়ে এসেই ভজবাবুর চেহারাটা একদম পাল্টে গেল। ভরসন্ধেবেলা দশবার ওঠবোস! হাতে পিস্তল থাকতেও!
ভাবতে-ভাবতে ভজবাবুর চেহারা হয়ে গেল খ্যাপা খুনীর মতো। সারা দুনিয়াকে তখন তাঁর দাঁতে-নখে ছিঁড়ে ফেলতে ইচ্ছে করছে। মাথাটা এত তেতে গেছে যে, মনে হচ্ছিল এক্ষুনি মাথার ব্রহ্মতালুতে আগ্নেয়গিরির গহ্বরের মতো ছাঁদা হয়ে মাথার ঘিলু তপ্ত লাভার মতো ছিটকে বেরিয়ে পড়বে।