এই বলে গোবিন্দনারায়ণ দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে আবার শশার থালার সামনে বসলেন। কৌস্তভ বিরক্ত হয়ে উঠে গেল। কিন্তু রাজা গোবিন্দনারায়ণের আর শশা খেতে ইচ্ছে করল না। ‘গাওয়া ঘিয়ের লুচি’ বাক্যটা তার মনের মধ্যে মশার মতো পন্ন্ পন্ করে উড়তে থাকে, আর মাঝে-মাঝে কুটুস করে কামড়ায়। বড্ড অস্বস্তি।
মন খারাপ হলে গোবিন্দনারায়ণ সোজা মাটির নীচের চোর কুঠুরিতে গিয়ে সিন্দুক খুলে টাকা গুনতে বসে যান। মন যদি অল্প খারাপ হয় তবে হাজার পাঁচ-সাত নোট গুনলেই আস্তে আস্তে মনটা ভাল হয়ে ওঠে। বেশি মন খারাপ হলে কখনও দশ বিশ ত্রিশ হাজারও গুনতে হয়। আজকে ‘গাওয়া ঘিয়ের লুচি’ কথাটা ভুলবার জন্য কত হাজার গুনতে হবে তা গোবিন্দনারায়ণ বুঝতে পারছিলেন না।
মনে হচ্ছে, আজ পঞ্চাশ-ষাট হাজার নোট গুনতে হবে। সেই সঙ্গে ফাউ হিসেবে হাজার দুই টাকার খুচরো পয়সাও গুনলে কেমন হয়? পঞ্চাশ হাজার নোটে ‘গাওয়া ঘি’ কথাটা ভুলতে পারলেও ‘লুচি’ কথাটা মন থেকে তুলতে ওই দু হাজার টাকার খুচরো দরকার হতে পারে।
সে যাই হোক, রাজা গোবিন্দনারায়ণ চাবির থোলো হাতে অন্দরমহলের ঘরে ঢুকে দরজা বন্ধ করলেন। তারপর মেহগিনির পালঙ্কের নীচে হামাগুড়ি দিয়ে গিয়ে মেঝের একটা জায়গা থেকে চৌকো একটা কাঠের পাটাতন সরালেন। গর্ত নেমে গেছে। সরু সিঁড়ি। একটা টর্চ নিয়ে গোবিন্দনারায়ণ সিঁড়ি বেয়ে সুড়ঙ্গপথে নামতে লাগলেন। হাত দশেক নামলে একটা সরু গলি। গলির গায়ে দুধারে মোট চারটে ঘর। বড় বড় মজবুত তালা ঝুলছে ঘরগুলোর লোহার দরজায়। প্রথম বাঁ হাতি ঘরটার তালা খুলে গোবিন্দনারায়ণ ঢুকে পড়ে আলো জ্বাললেন।
ছোট্ট ঘরটায় গোটা চারেক সিন্দুক রয়েছে। একটাতে একশো টাকার নোট, অন্যগুলোয় কোনওটাতে পাঁচ কোনওটাতে এক আর কোনওটায় কেবল খুচরো পয়সা।
রাজা গোবিন্দনারায়ণ আজ সব কটা সিন্দুকই খুলে ফেললেন। বাণ্ডিল বাণ্ডিল নোট হাসতে লাগল।
লোকে কাশ্মীর যায়, দার্জিলিং যায়, কন্যাকুমারিকায় গিয়ে বেড়ায়। কোথাও সূর্যোদয় দেখে, কোথাও সমুদ্র বা পাহাড় দেখে মুগ্ধ হয়, বা তীর্থে গিয়ে পুণ্য করে আসে। তেমনি এই চোর-কুঠুরিতে এলে গোবিন্দনারায়ণেরও কাশ্মীর, কুলুভ্যালি, দার্জিলিং বা কন্যাকুমারিকা দেখা হয়ে যায়। চোর কুঠুরির মতো এমন সুন্দর জায়গা দুনিয়ায় দ্বিতীয়টা নেই।
গোবিন্দনারায়ণ তাড়াহুড়ো করলেন না। মেঝেয় একটা কাঁঠাল কাঠের সিঁড়ি পেতে বসে ধীরেসুস্থে সব সিন্দুক থেকেই বাণ্ডিল বাণ্ডিল টাকা নামিয়ে মেঝেতে সাজালেন। গাওয়া ঘি থেকে শুরু করে লুচি পর্যন্ত পুরো বাক্যটা মন থেকে তুলে ফেলতে কত টাকা লাগবে তা আগেভাগে বলা মুশকিল।
দীর্ঘ দিন ধরে বার বার গোনবার ফলে নোটগুলো ভারী নেতিয়ে পড়েছে। ময়লাও হয়েছে বড় কম নয়। তা ছাড়া অনেক নোট এত পাতলা হয়ে গেছে যে একটু নাড়াচাড়া করলেই ছিঁড়ে যাবে। খুচরো পয়সাগুলোও আঙুলের ঘষা খেয়ে তেলতেলে হয়ে পড়েছে। এখন আর তাদের গায়ে লেখা অক্ষর ভাল করে বোঝাই যায় না।
গোবিন্দনারায়ণ খুব সাবধানে একটা বাণ্ডিল খুলে খুব আলতো আঙুলে টাকা গুনতে শুরু করলেন–এক…দুই…তিন…চার…
গুনতে গুনতে পাঁচশো ছশো পেরিয়ে হাজার ধরোধরা হয়ে গেল। গোবিন্দনারায়ণ চোর-কুঠুরির বন্ধ বাতাসে ঘেমে উঠছেন। একটু শ্বাসকষ্টও হচ্ছে। তবু বুঝতে পারছেন তার মন থেকে ‘গাওয়া’ কথাটা প্রায় লোপাট হয়ে গেছে। এত তাড়াতাড়ি ফল পেয়ে তিনি আরও তাড়াতাড়ি টাকা গুনতে লাগলেন। বাহ্যজ্ঞান প্রায় নেই।
ঠিক এক হাজার তিনশো ছাপ্পান্নটা নোটের সময়ে একটা গলার স্বর খুব কাছ থেকে বলে উঠল, “ইস! টাকাগুলো যে একদম অচল!”
রাজা গোবিন্দনারায়ণ বীরপুরুষের বংশধর। তাঁর ঊর্ধ্বতন চতুর্থ পুরুষ মহারাজ দর্পনারায়ণ ইংরেজদের সঙ্গে লড়াই করেছেন। তাঁর ছেলে সম্পদনারায়ণ মস্ত শিকারি ছিলেন। গোবিন্দনারায়ণের দাদু চন্দ্রনারায়ণ ঠ্যাঙাড়েদের ঠেঙিয়ে বিলেত থেকে কী একটা খেতাব পান। আর বাবা হংসনারায়ণ তেমন। কিছু না করলেও একবার একটা চোরকে জাপটে ধরে ফেলেছিলেন বলে কথিত আছে। এই সব বীরের রক্ত গায়ে না থাকলে চোর-কুঠুরিতে দ্বিতীয় মানুষের স্বর শুনে গোবিন্দনারায়ণ ঠিক মূছ যেতেন। গেলেন না। তবে হঠাৎ ডুকরে উঠে বললেন, “ওরে বাবা রে, মেরে ফেললে রে! কে কোথায় আছিস! এসে আমাকে ধরে তোল।”
ভয়ে গোবিন্দনারায়ণ ঘাড় ঘোরাতে পারছেন না। না, আসলে তিনি তেমন ভয় পাননি, ঘাড়টাই ভয় পেয়ে শক্ত হয়ে গেছে। চোখদুটোও ভয় পেয়ে ঢাকনা ফেলে বসে আছে, খুলতে চাইছে। আর হাত পাগুলো বেয়াদপের মতো থরথর করে কাঁপছে।
গলার স্বরটা একটু কাছে এগিয়ে এসে বলল, “মহারাজ, ভয় পেলেন নাকি? ভয়ের কিছু নেই। আমি গোয়েন্দা বরদাচরণ।”
মুহূর্তে ঘাড় ঢিলে হয়ে গেল, চোখের পাতা খুলে গেল, আর গোবিন্দনারায়ণের বীরের রক্ত টগবগ করে উঠল। তিনি ধমক দিয়ে বললেন, “তুমি এখানে এলে কেমন করে, হ্যাঁ?”
বরদাচরণ খুবই তাচ্ছিল্যের হাসি হেসে বললেন, “এ আর কী দেখলেন? একবার একটা আঙুলের ছাপ খুঁজতে আলিপুরের টাঁকশালে ঢুকে গিয়েছিলাম সকলের চোখকে ফাঁকি দিয়ে। গোয়েন্দাদের সব বিদ্যে থাকা চাই।”