ভজবাবু গম্ভীর হয়ে বললেন, “ঠিক আছে, মোষ নিয়ে চলে যা। আর যদি কখনও..”
“রাম, রাম। আউর কখনো হোবে না।” বলে হরশঙ্কর তার মোষ নিয়ে চলে গেল।
ভজবাবু পিস্তলের দিকে চেয়ে দাঁড়িয়ে রইলেন। তাঁর মুখে অদ্ভুত একটা হাসি। সত্যিই পিস্তলের মতো জিনিস হয় না। এই পিস্তল নিয়ে বাজারে গেলে দোকানিরা একঝটকায় দাম কমিয়ে প্রায় জিরোতে নামিয়ে ফেলবে। পিস্তলটাকে এক হাতে ধরে অন্য হাতে সেটার গায়ে হাত বোলাতে বোলাতে ভজবাবু আপনমনে বললেন, “তাই তো বলি, একটা পিস্তল ছিল না বলেই এতকাল কেউ আমাকে গ্রাহ্য করছিল না।”
ভাবতে ভাবতে ভজবাবুর রক্ত গরম হয়ে গেল। তাঁর মনে হতে লাগল, এই পিস্তলের জোরে তিনি যা খুশি করতে পারেন। যত বড় বদমাশ বা গুণ্ডা হোক সবাই পিস্তলের সামনে হরশঙ্করের মতোই ভেজানো ন্যাতা হয়ে নেতিয়ে পড়বে।
ভজবাবুর খুব ইচ্ছে হল, পিস্তলের শক্তিটা একটু ভাল করে পরখ করেন। তাই কাউকে কিছু না বলে র্যাপারের তলায় পিস্তলটা লুকিয়ে নিয়ে ভজবাবু বাড়ি থেকে বেরিয়ে পড়লেন।
এবার সবাইকে তিনি বুঝিয়ে দেবেন কত ধানে কত চাল।
কিরমিরিয়ার চেঁচামেচি শুনে বাড়ির লোকজন দৌড়ে এসেছিল। কিন্তু তারা এসে ভজবাবুকে খুঁজে পেল না।
৪. হরিণগড়ের রাজা গোবিন্দনারায়ণ
হরিণগড়ের রাজা গোবিন্দনারায়ণ সন্ধেবেলা আহ্নিক সেরে জলযোগ করছেন। মস্ত বড় এক শ্বেতপাথরের টেবিলের ওপর রুপোর থালায় ডাঁই করে কাটা শশা দেওয়া হয়েছে। গোবিন্দনারায়ণ সোনার চামচ দিয়ে শশা মুখে তুলে কচমচ করে চিবোচ্ছেন। মুখে একটা তৃপ্তির ভাব।
টেবিলের অন্য ধারে গোবিন্দনারায়ণের ভাগনে কৌস্তভনারায়ণ বসে মামার শশা খাওয়া দেখছে। গোবিন্দনারায়ণের মতো শশাখোর লোক কৌস্তভ আর দেখেনি। একটা মানুষ একা যে কত শশা খেতে পারে, তা হরিণগড়ে এসে রাজা গোবিন্দনারায়ণকে
দেখলে বোঝা যায় না। কৌস্তভ অবশ্য মামার শশা খাওয়া দেখতেই যে এসে বসে থাকে তা নয়। তার অন্য মতলব আছে। মামার নিরুদ্দেশ ছেলে কন্দর্পনারায়ণ যদি আর ফিরে না আসে, তবে মামার বিষয়সম্পত্তি সব সেই পাবে। সেই আশায় কৌস্তভ প্রায়ই আনাগোনা করে। চারদিকে ঘুরঘুর করে মামার বিষয়সম্পত্তি কত তা বুঝবার চেষ্টা করে।
পঁয়তাল্লিশটা শশার টুকরো খাওয়ার পর গোবিন্দনারায়ণ একটা পেল্লায় ঢেকুর তুলে একটু দম নেওয়ার জন্য চামচটা রাখলেন। পেটের মধ্যে জায়গা করার জন্য উঠে একটু পায়চারি করতে লাগলেন।
কৌস্তভ সুযোগ বুঝে খুব সতর্ক গলায় জিজ্ঞেস করল, “মামাবাবু, কন্দর্পর কোনও খবর পেলেন?”
গোবিন্দনারায়ণ তাঁর ভাগনেটিকে বিশেষ পছন্দ করেন না। ভাগনে কৌস্তভ বলে নয়, আসলে তিনি কোনও আত্মীয়স্বজনকেই ভাল চোখে দেখেন না। তার কারণ, আত্মীয়স্বজন এলেই তাদের সঙ্গে নানারকম লৌকিকতা করতে হয়। ভাল-মন্দ খাওয়াও রে, ধারকর্জ দাও রে, গরিব বলে সাহায্য করো রে, পালা-পার্বণে জামাকাপড় দাও রে।
রাজা গোবিন্দনারায়ণ বড় কৃপণ মানুষ। তিনি নিজে কখনও প্রাণে ধরে ভাল-মন্দ খান না, কাউকে খাওয়াতে ভালবাসেন না। রাজা হয়েও তিনি ছেঁড়া জামাকাপড় সেলাই করে পরেন। বাবুগিরি তিনি দু চক্ষে দেখতে পারেন না। তাঁর সবচেয়ে প্রিয় শখ হল অবসর সময়ে আপনমনে টাকা গোনা। রাজবাড়ির গুপ্ত কুঠুরিতে লোহার সিন্দুক থেকে টাকা বের করে ঘণ্টার পর ঘণ্টা গোনেন। শোনা যায়, এক টাকার নোটে আর খুচরো পয়সায় দশ বিশ হাজার টাকা কয়েক ঘণ্টায় গুনে ফেলতে পারেন। কিন্তু সে সব টাকা কেবল গোনার জন্যই।
ভাগনে কৌস্তভের দোষ হল সে সবসময়ে এক পেট খিদে নিয়ে মামাবাড়িতে আসে। এসেই মামি বা দিদিমার কাছে গিয়ে বলে, “ওঃ, যা একখানা খিদে পেয়েছে না, দশটা চাষার ভাত একাই খেতে পারি এখন।”
তা পারেও কৌস্তভ। চেহারাটা রোগা-রোগা হলেও খেতে বসলে তাজ্জব কাণ্ড ঘটিয়ে ফেলে। একবার আশিটা কৈ মাছ খেয়েছিল, অন্যবার বাহাত্তরটা রাজভোগ। সেসব ভাবলে। কৌস্তভকে দেখে গোবিন্দনারায়ণের খুশি হওয়ার কথা নয়।
প্রশ্ন শুনে গোবিন্দনারায়ণ বললেন, “না। অন্ধকার হয়ে এল কস্তু, বাড়ি যাবি না?”
কৌস্তভ ঘড়ি দেখে বলল, “রাত আর কই হল! শীতের বেলা বলে আলো চলে গেছে। এই তো পৌনে ছটা মাত্র। তা মামাবাবু, কন্দর্পকে খোঁজার জন্য আপনি নাকি গোয়েন্দা লাগিয়েছেন?”
“সে আমি লাগাইনি। গুচ্ছের টাকার শ্রাদ্ধ। গোয়েন্দা লাগিয়েছে তোর মামি। মর্কট গোয়েন্দাটা নাকি পাঁচশো টাকা করে নেবে ফি মাসে। শুনে ভিরমি খাওয়ার জোগাড়। আমি স্রেফ বলে দিয়েছি, আগে খুঁজে বের করো, তারপর টাকাপয়সার কথা হবে। কস্তু, আজ বড় ঠাণ্ডা পড়বে রে, এই বেলা না হয়। দুগা-দুগা বলে বেরিয়ে পড়।”
কৌস্তভ বিরক্ত হয়ে বলে, “বেরোতে বললেই কি বেরোনো যায়! আজ মামিকে বলেছি গাওয়া ঘিয়ের লুচি খাব। মামি রাজি হয়েছে।”
গোবিন্দনারায়ণ আঁতকে উঠে বললেন, “ও বাবা রে!”
কৌস্তভ তাড়াতাড়ি উঠে বলল, “কী হল মামাবাবু, কিছু কামড়াল নাকি?”
“না বাবা, কামড়ায়নি। গাওয়া ঘি কত করে দর যাচ্ছে বল তো?”
“ওঃ। কত আর হবে! বেশি নয়।”
“তোদের আর কী! যার যাচ্ছে তার যাচ্ছে। তা যা, বরং তোর মামির কাছেই গিয়ে বোস গে।”