সকালবেলাতেই দুঃখহরণবাবুর বিপদ। সেই সময়টায় মনোজের বাবা রাখোহরিবাবু পড়ার ঘরে এসে বসে গম্ভীরভাবে খবরের কাগজ পড়েন। রাখোবাবু ভীষণ রাশভারী লোক, বাড়ির কুকুরটা বেড়ালটা পর্যন্ত তাঁকে ভয় খায়, বাড়ির লোকজনের তো কথাই নেই। কিন্তু সকালবেলাতে রাখোবাবু যে মনোজদের পড়ার ঘরে এসে বসেন তার একটা কারণ আছে। এবাড়িতে একজন মানুষ আছেন, যিনি রাখোবাবুকে মোটেই ভয় খান না, বরং উল্টে রাখোবাবুই তাঁর ভয়ে অস্থির। তিনি রাখোবাবুর পিসিমা আদ্যাশক্তি দেব্যা। বাবার পিসিকে ঠাকুমা ঠাকুরঝি বলে ডাকেন, সেই থেকে মনোজরা সবাই তাঁকে ‘ঠাকুরঝি’ ডাকে। তিনি খুব অল্প বয়সে বিধবা হয়েছিলেন, সেই থেকে উপোস-টুপোস করে করে বুড়ো বয়সে ভীষণ তেজস্বিনী হয়ে গেছেন। কারও তোয়াক্কা করেন না। তাঁর আবার ভয়ংকর শুচিবাই। সকালে কাঁচা গোবর জলে গুলে সেই জল সারা বাড়িতে ছিটিয়ে দেন। মনোজদের পড়ার ঘরটা বাড়ির বাইরে, বাগানের ধারে। একটেরে ছোট্ট একটু ঘর, তাতে এক ধারে পড়ার টেবিল চেয়ার, অন্য ধারে তক্তপোশের ওপর দুঃখহরণবাবুর বিছানাপত্র। এই ঘর অবধি ঠাকুরঝি আসতে পারেন না, খোঁড়া পায়ে বাগান পেরোতে কষ্ট হয়। তাই এ-ঘরটা গোবরজলের হাত থেকে বেঁচে যায়। রাখোবাবু তাই গোবরের গন্ধ এড়িয়ে নিশ্চিন্তে শ্বাস নেওয়ার জন্য এই ঘরে এসে ঘণ্টাখানেক কাটিয়ে যান, ততক্ষণে ঘরদোরের জল শুকিয়ে যায়।
রাখোবাবু কড়া ধাতের লোক, আদবকায়দার নড়চড় দেখলে খুব রাগ করেন। তাই সেসময়টায় দুঃখহরণবাবুকে পা ঝুলিয়ে বসে থাকতে হয়। আর ওই এক ঘণ্টায় দুঃখহরণবাবু রাজ্যের ভুলভাল করতে থাকেন। একদিন তিনি ওই অবস্থায় ট্রানস্লেশন করতে গিয়ে তখন হলঘর ভরিয়ে গিয়াছে এই বাক্যটার ইংরেজি করলেন বাই দেন দি হল রুম ওয়াজ ফুলফিলড়। এই ইংরেজি শুনে বাবা তাঁর ইংরেজি খবরের কাগজ থেকে মুখ তুলে বিরক্ত হয়ে তাকালেন। ছেলেমেয়ের সামনে মাস্টারমশাইয়ের ভুল ধরলে, তাঁর প্রতি শ্রদ্ধা কমে যেতে পারে, সেই জন্য বললেন–”দুঃখবাবু, ইংরিজিটা ঠিকই আছে, তবে একটু কানে কেমন যেন লাগছে। আর একবার অন্যভাবে করুন।” কিন্তু দুঃখহরণবাবু পা ঝুলিয়ে বসে আছেন যে, তার ওপর রাশভারী রাখোবাবুর কথা শুনে আরও ঘাবড়ে গিয়ে খুব শক্ত ইংরেজিতে বললেন–”দি হল’স ফুলফিলমেন্ট ওয়াজ অ্যাচিভড বাই দেন।” শুনে রাখোবাবু আর মুখ তুললেন না। দুঃখহরণবাবুও গোলমালটা বুঝতে পারছেন, কিন্তু উবু হয়ে না বসলে তাঁর মুড আসে না। তাই তিনি ঠ্যাং দুটো জোর-নাচাতে নাচাতে মুখে ‘হুঁ হুঁ করে একটা শব্দ করে যেতে লাগলেন। দাদা সরোজ, দিদি পুতুল, আর মনোজ চুপিসারে হাসাহাসি করছে।
শীতকাল। বাগানে, খুব ফুল ফুটেছে। সামনের দিকটায় মস্ত মস্ত গাঁদা ফুটে আছে, সেগুলো এত বড় যে দু হাতে মুঠো করেও বেড় পাওয়া যায় না। মোরগ ফুল, পপি, গোলাপ তো আছেই। ফটফটে রোদে প্রজাপতি আর ফড়িং উড়ছে অনেক, পোকামাকড় টি টি করে ঘুরে বেড়াচ্ছে। বাগানের অন্য ধারে পালং খেত, ফুলকপি, ওলকপি, ধনেপাতা, বেগুন লাগানো হয়েছে। সেই সবজি খেতে দেহাতি বুড়ো মানুষ রামখিলাওন খুরপি হাতে ঘুরঘুর করছে। যদিও একটা ঠিকে মালী এসে বাগানের কাজ করে যায় রোজ, তবু রামখিলাওন কাজ দেখানোর জন্য বাগানে সব সময়ে কিছু খোঁড়াখুঁড়ি করবেই। চোখে ভাল দেখতে পায় না, অনেক সময়ে গাছের গোড়ার মাটি খুঁড়ে আলগা করতে গিয়ে শেকড়বাকড় উপড়ে ফেলে। আগাছা তুলতে গিয়ে ফুলগাছ তুলে ফেলে দিয়ে আসে। বকুনি খেলে খুব গম্ভীরভাবে থাকে, যেন এ-সব বকাবকি তার তেমন গায়ে লাগে না। গতবার ঠাকুমার চশমা পালটানো হল, আর রামখিলাওন ঠাকুমার পুরনো চশমাটা চেয়ে নিল। সেই চশমাটা এখন সব সময়ে চোখে পরে থাকে। তাতে যে সে ভাল দেখতে পায় তা নয়। কিন্তু এমন ভাব দেখায় যে খুব ভাল দেখছে। চশমা পরে ইজ্জতও বেড়ে গেছে তার। বাজারের কাছে দেশওয়ালী ভাইদের কাছে চশমা পরে যাওয়ায় সেখানে তার খাতিরও নাকি বেড়ে গেছে। বাড়ির চাকর রঘু তাকে ‘রামু বলে ডাকলে বা তুই-তোকারি করলে সে ভারী চটে যায়। রঘু তাই তাকে আজকাল রামুবাবু বলে ডেকে আপনি-আজ্ঞে করে। কিন্তু সন্ধে হলেই রঘু নানা কায়দা করে রোজ রামুকে ভূতের ভয় দেখাবেই।
.
আজ দুঃখহরণবাবুর ভুলভাল কিছু বেশি হচ্ছে। দাদা সরোজকে ইতিহাস বোঝাতে গিয়ে তিনি বরাবার ওয়ার্ড মিনিং বোঝাতে লাগলেন, ইতিহাস বইতে দুটো ব্যাখ্যাও দাগিয়ে দিলেন। পুতুলকে সুদকষা বোঝাতে গিয়ে তিনি হুঁশিয়ার করে দিয়ে বললেন, “মুখস্থ যেন ভুল না হয়, আর দাঁড়ি কমা সেমিকোলন সম্পর্কে সাবধানে থাকবে।” মনোজের ভুগোল বই খুলেও তিনি গোলযোগ করে ফেললেন, পশ্চিমবঙ্গের কোন্ কোন্ জেলায় ধান ও পাট জন্মায় তা বলতে গিয়ে তিনি বারবার নর’ শব্দের রূপ এনে ফেলছিলেন। তাই শুনে রাখোবাবু বিরক্ত হয়ে উঠে পড়লেন। ঘরে গোবরের গন্ধ, পড়ার ঘরে ভুলভাল পড়ানো, কোথায় আর যাবেন! তাই বাগানে পায়চারি করতে করতে দেখেন, রামু একমুঠো দুব্বো ঘাস, কয়েকটা কড়াইশুটি আর একটা গাজর বাগান থেকে তুলে নিয়ে যাচ্ছে।
রাখোবাবু জিজ্ঞেস করলেন, “ওসব কোথায় নিচ্ছিস রে রামু? দেখি, কী তুলেছিস?”