কোনও জবাব নেই। খুটুর-মুটুর শব্দ হতেই লাগল। ভজবাবুর ঘরের ভিতরে ঢুকতে তেমন সাহস হল না। যদি চোর হয়ে থাকে তো বেশ সাহসী চোরই হবে। ভজবাবুর সাড়া পেয়েও ঘাবড়ায়নি। এ-সব চোর বড় সাংঘাতিক হয়।
ভজবাবু ভিতর-বাড়িতে চলে এলেন। দেখেন কিরমিরিয়া উঠোনে চাল ছড়াচ্ছে, আর সেই ভুতুড়ে কাকটা মহানন্দে নেচে নেচে চাল খাচ্ছে।
ভজবাবু বললেন, “কিরমিরিয়া, একটু সঙ্গে আয় তো! চোর-কুঠুরিতে একটা চোর ঢুকে বসে আছে বলে মনে হচ্ছে।”
শুনেই কিরমিরিয়ার হাত থেকে চালের বাটিটা পড়ে গেল ঠুং করে। সে পরিত্রাহি চেঁচাতে লাগল, “ও বাবাগো, বাড়িতে চোর ঢুকল গো! এখন চোরকে কে ধরবে গো! চোর যে আমাদের মেরে ফেলবে গো!”
“চোপরও!” ভজবাবু এক পেল্লায় ধমক দিলেন।
সেই ধমকে কিরমিরিয়ার দাঁতকপাটি লাগবার জোগাড়। সে উঠোনে উবু হয়ে বসে মুখ বন্ধ করে গোঁগোঁ শব্দ করতে থাকে।
ভজবাবু রেগে গিয়ে বললেন, “যা, আজই তোকে চাকরি থেকে বরখাস্ত করলাম।”
সেই শুনে কিরমিরিয়া চোখ মুছতে মুছতে উঠল। বিড়বিড় করে বলতে লাগল, “আজ আমাকে চোর মারবে গো। মেরে ফেললে আর কী করে বেঁচে থাকব গো! ও ভজবাবু গো, আমি মরে গেলে কে তোমাদের বাসন মাজবে, কাপড় কাঁচবে, ঘর মুছবে, খুঁটে দেবে গো!”
কিরমিরিয়াকে সঙ্গে নিয়ে আর একটা দা হাতে করে ভজবাবু চোরকুঠুরির সামনে এসে বন্ধ দরজায় কান পেতে শুনলেন, ভিতরে এখনও সেই শব্দ।
ভজবাবু বাইরে থেকে হুঙ্কার ছাড়লেন, “কে আছিস ভেতরে? শোন ব্যাটা, ভাল চাস তো এক মিনিটের মধ্যে বেরিয়ে চলে যা। তা হলে কিছু বলব না। আর যদি বেশি ট্যাণ্ডাই-ম্যাণ্ডাই করিস তো রক্ষে নেই কিন্তু।”
কিরমিরিয়া কেঁদে উঠে বলল, “ও চোর-দাদাবাবু গো, ভজদাদাবাবুকে আর আমাকে মেরো না গো। ভালয় ভালয় চলে যাও গো।”
কিন্তু কুঠুরির ভিতরে চোরের তেমন গা নেই। শব্দটা হতেই লাগল।
ভজবাবু আর কী করেন! যদি চোর তাড়া করে, তবে দৌড়তে হবে বলে কাছাটা এঁটে নিয়ে এক হাতে টর্চ অন্য হাতে দাটা বাগিয়ে ধরে দড়াম করে দরজাটা খুলে ফেলেই তিন হাত পিছিয়ে সরে দাঁড়ালেন। না, তাতেও চোরটা বেরলো না। ভজবাবু শাসালেন, “বেরিয়ে আয় বলছি। বেরোলি?”
কোনও জবাব নেই।
ভজবাবু তখন পা টিপে টিপে ঘরের চৌকাঠে গিয়ে ভিতরে টর্চের আলো ফেলেই বললেন, “দূর! এ যে দেখছি বেড়ালটা। যাঃ যাঃ।”
খুব সাহসের সঙ্গে ভজবাবু ভিতরে ঢুকলেন। বেড়ালটা তাড়া খেয়ে পালাল। ভজবাবু চারদিকে টর্চ ফেলে ফেলে দেখলেন, হতচ্ছাড়া বেড়াল ঘরটাকে যাচ্ছেতাই রকমের বেগোছ করেছে। একধারে পুতুলের পুতুল খেলার বাক্সটাক্স সব হাঁটকে মাটকে একশেষ। ভজবাবু নিচু হয়ে পুতুলের বাক্সটা গুছিয়ে রাখতে যাচ্ছিলেন। তারপরই হঠাৎ ‘বাবা গো’ বলে চেঁচালেন।
সেই চিৎকারে বাইরে কিরমিরিয়া আরও জোরে চেঁচাল।
ভজবাবু স্তম্ভিতমুখে একটা পিস্তল হাতে করে নিয়ে বেরিয়ে এসে বললেন, “কিরমিরিয়া, চুপ কর। ব্যাপারটা খুব সিরিয়াস। এ-সব চোর-টোরের কাণ্ড নয়। কোনও ডাকাত বাড়িতে ঢুকেছে। এই দ্যাখ ডাকাতের পিস্তল। অস্ত্রটা এই ঘরে লুকিয়ে রেখে ডাকাতটা নিশ্চয়ই কোথাও ঘাপটি মেরে আছে। লোকজন সব ডাক এক্ষুনি।”
“বাবা গো, ডাকাত গো,” বলতে বলতে কিরমিরিয়া দৌড়াল। ভজবাবু টর্চ আর পিস্তল হাতে পাছ-দুয়ারের দিকে তফাতে গিয়ে দাঁড়ালেন। ঘন ঘন গায়ত্ৰীমন্ত্র জপ করছেন আর চারদিকে নজর রাখছেন।
ঠিক এই সময়ে কাঁধে রামু আর হাতে মোষের দড়ি ধরে হরশঙ্কর গোয়ালা গোয়ালঘর থেকে বেরিয়ে পাছ-দুয়ারের দিকে আসছিল। রামু দু হাত জড় করে ঝুলতে ঝুলতে বলছে, “জয় বাবা রামজি, আমার তো কাল ফাঁসি হয়ে যাবে।”
দৃশ্যটা দেখে ভজবাবু হাঁ। আজকাল চোর ডাকাতের যে কী পরিমাণ সাহস বেড়েছে। এই ভর সন্ধেবেলা গেরস্তর ঘুরে ঢুকে গরু মানুষ সব ধরে ধরে নিয়ে যাচ্ছে। ডাকাতটার চেহারা যেমন পেল্লায়, তেমনি হাবভাবও রাজা জমিদারের মতো। দৌড়ে পালাবি, তা নয়, কেমন গদাই লস্করের মতো চলছে দেখ।
ডাকাতটার এই সাহস দেখে ভজবাবু খুব রেগে গেলেন। বেয়াদপির একটা শেষ থাকা দরকার। তিনি একেবারে মুখোমুখি দাঁড়িয়ে মুখে টর্চ ফেলে পিস্তলটা বাগিয়ে ধরে বললেন, “তুই কে রে পাজি? ভর সন্ধেবেলা মানুষ গরু চুরি করছিস, তোর আক্কেলটা কীরকম? চুরি করবার এই নাকি সময় তোদের? চক্ষুলজ্জা বলে জিনিস নেই?”
হরশঙ্কর মস্ত বড় পালোয়ান বটে, কিন্তু পিস্তল দেখে তার রক্ত জল হয়ে গেল। সে রামুকে ধমাস করে মাটিতে ফেলে দিল, মোষের দড়িও ছেড়ে দিল। দু হাত জোড় করে বলল, “গোড় লাগি ভজবাবু, এই রামু বদমাশটা আমার ভঁইসটাকে চুরি করেছিল, তাই ভাবলাম, যাই গিয়ে ভঁইসটাকে নিয়ে আসি।”
ভজবাবু উত্তেজনায় হরশঙ্করকে প্রথমে চিনতে পারেননি, এখন চিনতে পেরে পিস্তলটা আরও ভালভাবে বাগিয়ে ধরে বললেন, “ও, তুই সেই পাজি হরশঙ্কর, না? দুধে জল মেশাস!”
হরশঙ্কর কাঁদো কাঁদো হয়ে বলে, “আর কখনও মিশাব না। হুজুর, মাফি মাঙে।”
হুম! ভজবাবু একটু ভাবলেন। তারপর বললেন, “সবই তো বুঝলাম। কিন্তু পিস্তলটা এল কোত্থেকে! আর ডাকাতটাই বা গেল কোথায়?”
পিস্তলের গুণ দেখে ভজবাবু অবাক। এত বড় পালোয়ান হরশঙ্কর গোয়ালা পিস্তলের সামনে কেমন নেতিয়ে পড়ল। হাঁটু গেড়ে বসে হাতজোড় করে বলল, “বড়বাবু, জান বাঁচিয়ে দিন। কান পাকড়াচ্ছি, আর দুধে জল দিব না। আপনাদের কোঠিতেও কখনও ঘুষব না।”