হারাধন বিরক্ত হয়ে উঠোনে পায়চারি করছিল। সতীশ ভরদ্বাজের কথা শুনে বলল, “হাঁদু-উঁদুর ছুটি ক্যানসেল করে একটা টেলিগ্রাম করে দিন না ঠাকুরমশাই।”
সতীশ ভরদ্বাজ হারাধনকে দেখতে পারেন না। দু পাতা বিজ্ঞান পড়ে এরা ঘোর নাস্তিক হয়ে গেছে। কিছু মানে না। ভরদ্বাজ ঠাকুরমশাই রেগে গিয়ে বললেন,”টেলিগ্রাম করব, ইয়ার্কি পেয়েছ নাকি? তাদের দেশ তো আর শহর গঞ্জে নয় যে, টেলিগ্রাম যাবে। তারা থাকে প্রেতলোকের গহীন রাজ্যে। সেখানে আলো নেই, অন্ধকার নেই, কেবল ঘোর সন্ধেবেলার মতো আবছা এক জায়গা। চারদিকে ছমছম করছে অদ্ভুত গাছপালা, পাহাড় হ্রদ। মড়ার মাথা চারদিকে ছড়ানো, হ্রদে জলের বদলে রক্ত, পাহাড় হচ্ছে হাড়গোড় দিয়ে তৈরি। বাদুড়, শকুন আর পেঁচা ছাড়া কোনও পাখি নেই। সেখানকার গাছে ফুল ফুটলে পচা নর্দমার গন্ধ ছাড়ে। সেখানে আকাশের রঙ ঘোর কালো, চাঁদ তারা সূর্য কিছু নেই। সেখানকার রাজার প্রাসাদ তৈরি হয়েছে মাথার খুলি দিয়ে। গায়ে গায়ে পিশাচ, শাঁকচুন্নি, মামদো, ব্রহ্মদৈত্য, খোস সব সেখানে বসবাস করে। আমি কতবার গিয়েছি।”
হারাধন হেসে ফেলে বলে, “জায়গাটা বেশ ভাল মনে হচ্ছে ঠাকুরমশাই। একবার আমাকে নিয়ে চলুন না।”
সতীশ ভরদ্বাজ সেকথার জবাব দেননি। শুধু বলেছেন, “আসুক হাঁদু-ভুঁদু, বিশ্বাস না হয় তাদের মুখেই শুনে নিয়ো।”
এই বলে ঠাকুরমশাই চলে গেলেন।
বিকেলের দিকে গরু দোয়াতে গিয়ে রামু মহাবিপদে পড়ল। চোখে ভাল ঠাহর হয় না তার, কিন্তু তা বলে একেবারে কানাও তো সে নয়। হাতিয়ে-টাতিয়ে, নিরীখ-পরখ করে সব জিনিসেরই একটা আন্দাজ পায়। আজ যেন সে গোয়ালে ঢুকে হারিকেনের গায়ে হাত দিয়েই বুঝতে পারল, গরুটা আর আগের মতো নেই। দিব্যি বড়সড় হয়ে উঠেছে, গায়ে খোঁচা-খোঁচা লোম, আর ভারী ঠাণ্ডা স্বভাব, দুধ দোয়ানোর সময় রোজ যেমন দাপাদাপি করে, বালতি উল্টে ফেলে দেয় বা পায়ের চাঁট ছোড়ে, আজ তেমন কিছু করল না। দুধও দিল এক কাঁড়ি। বালতি ভরে প্রায় উপচে পড়ে আর কী! খুব আনন্দ হল রামুর। কিন্তু বালতি-ভরা দুধ নিয়ে সে যখন হাসি-হাসি মুখ করে গোয়াল থেকে বেরোতে যাচ্ছে তখন দোরগোড়ায় একটা মুশকো মতো লোকের সঙ্গে ধাক্কা খেল।
“কৌন হ্যাঁয় রে?” বলে রামু চোখ পাকিয়ে তাকায়।
মুশকো লোকটা দরজা জুড়ে দাঁড়িয়ে ফোঁসফোঁস করে নিশ্বাস ফেলছে। এমন ব্যাদড়া লোক যে, রামুর পথও ছাড়ছে না।
ভয় পেয়ে রামু চেঁচাল, “কৌন চোট্টা হ্যাঁয় রে! এখনও সন্ঝা হয়নি, এরই মধ্যে গরু চোরাতে এসেছিস?”
এই বলে রামু বালতিটা রেখে হঠাৎ দুহাতে লোকটাকে জাপটে ধরে চেঁচাতে থাকে, “এ মিশিরজি, এ রঘু, জলদি আও। গরু চোর ধরেছি।”
মুশকো লোকটা পেল্লায় জোয়ান। এক ঝটকায় রামুর হাত ছাড়িয়ে উল্টে তার ঘাড়টা চেপে ধরে বলল, “চোর আমি না তুই? আমার ভঁইসটাকে সারা দু পহর ছুঁড়ে বেড়াচ্ছি, আর তুই চোট্টা আমার দুধেল ভঁইস ধরে এনে গোহালে বেঁধে রেখেছিস!”
রামু তখন বুঝতে পারল, এ লোকটা হল হরশঙ্কর গয়লা। এ-তল্লাটে হরশঙ্কর হচ্ছে সবচেয়ে বড় পালোয়ান। বজরঙ্গবলী মন্দিরের সামনের আখড়ায় একটা কুস্তির দঙ্গল আছে। সেখানে ফি বছর কুস্তির প্রতিযোগিতায় হরশঙ্কর অন্য সব জোয়ানদের ধরে ধরে ধোবিপাট প্যাঁচ মেরে আছাড় দেয়। ধোপা কাপড় কাঁচবার সময় যেমন করে আছাড় মারে, তাই হল ধোবিপাট, হরশঙ্করকে সবাই খুব সমঝে চলে।
রামুর চেঁচানি শুনে মিশির আর রঘু দুই লাঠি নিয়ে ধেয়ে এসেছিল, কিন্তু হরশঙ্করকে দেখে লাঠি ফেলে দিয়ে হাতজোড় করে রাম রাম’ বলে খুব খাতির দেখাতে লাগল।
হরশঙ্কর কাউকে গ্রাহ্য করল না, রামুকে কাঁধে ফেলে আর মোষটাকে খোঁটা থেকে দড়িসুদ্ধ খুলে এক হাতে দড়ি ধরে রওনা দিল। যাওয়ার সময় বলে গেল, “রামু চোট্টাকে আজ পুলিশে দেব।”
রামু হরশঙ্করের কাঁধে ঝুলতে ঝুলতে কেঁদে-কেঁদে বলতে লাগল, “এ রঘু, এ মিশিরজি, আমার যদি ফাঁসি হয় তো আমার মুলুকমে একটা খত লিখে দিয়ে, পুলিশলোগ কি আমাকে পেটাবে নাকি রে বাপ? আমি কখুনো মারধোর খাইনি, কীরকম লাগবে কে জানে? ও হরশঙ্করভাই, অত জোরসে হাঁটছ কেন, আমার যে ঝাঁকুনি লাগছে!”
হরশঙ্কর কী করত বলা মুশকিল। কিন্তু গোয়াল থেকে বেরিয়ে যেই সে পাছদুয়ার দিয়ে বারমুখো রওনা দিয়েছিল–
সন্ধে হলেই ভজবাবু টর্চ নিয়ে সারা বাড়ি ঘুরে বেড়ান। বাড়িটা বেশ বড়ই বলতে হবে। উঠোনের চারদিক ঘিরে অনেকগুলো ঘর। তা ছাড়া বাইরের দিকে বাগানের দুধারে পড়া, গান শেখা এবং বৈঠকখানার জন্য আলাদা-আলাদা ঘর আছে। এত বড় বাড়ির আনাচকানাচও তো কিছু কম নেই। সন্ধের অন্ধকারে কোন চোর ছাঁচোড় বাড়ি ঢুকে ঘাপটি মেরে বসে থাকবে কে জানে! তারপর মাঝরাতে সবাই ঘুমোলে মালপত্র নিয়ে ভাগারাম দেবে। সেই ভয়ে ভজবাবু সন্ধে হলেই টর্চ হাতে সারা বাড়ি ঘুরে ঘুরে দেখেন কেউ কোথাও লুকিয়ে আছে কিনা, ছাদ, সিঁড়ি, খাটের তলা, পাটাতন সব জায়গা।
আজও ভজবাবু ঘুরে বেড়াতে বেড়াতে পিছনের দিকে একটা বাজে জিনিস রাখবার কুঠুরির সামনে এসেই শুনতে পেলেন ঘরটার ভিতরে খুটুর-মুটুর শব্দ হচ্ছে।
ভজবাবু খুব সাহসী লোক নন। শব্দ শুনেই ভড়কে গিয়ে কাঁপাগলায় জিজ্ঞেস করলেন, “ভিতরে কে-এ-এ?”