ভিড়ের ভিতর থেকে একটা লোক তার গায়ের লাল ব্যাপারটা খুলে বরদাচরণের দিকে ছুঁড়ে দিয়ে বলল, “বরদাবাবু, আমাদের আসল বুল ফাঁইট দেখিয়ে দিন।”
হারিকেনের তৃতীয় ঢুটা এড়াতে গিয়ে বরদাচরণ মাটিতে পড়ে গিয়েছিলেন। হারিকেন আবার ফিরে আসছে। বরদাচরণ করেন কী? তাড়াতাড়ি লাল র্যাপারটা নিয়ে উঠে দাঁড়িয়ে বুল ফাঁইটারের মতোই হারিকেনকে দেখিয়ে সেটা নাড়তে লাগলেন। হারিকেন দৌড়ে এল। বরদাচরণ খুব দক্ষতার সঙ্গে সরে গেলেন। কিন্তু হারিকেন বোকা ষাঁড় নয়, সে হল ত্যাঁদড়া গরু। বরদাচরণের ওপর তার রাগ কেন তা অবশ্য বোঝা গেল না। কিন্তু লাল র্যাপার নিয়ে বরদাচরণকে ইয়ার্কি করতে দেখে, তার রাগ চড়ে গেল কয়েক ডিগ্রি। চারদিকে লোকজন শাবাশ! বাহবা! হুররে। লেগে যা, ঘুরে ফিরে।’ বলে চেঁচাচ্ছে। তাই শুনে আরও খেপে গেল হারিকেন। কিন্তু এবার আর সে তাড়াহুড়ো করল না। খুব ভাল করে বরদাচরণকে লক্ষ করে দেখে নিল। তারপর হাঁটি-হাঁটি পা-পা করে এগিয়ে এসে আচমকা ধেয়ে এসে তার চার নম্বর হুঁ লাগাল।
সেই ছুঁতে হাতি পর্যন্ত টলে যায় তো মানুষ কোন ছার! বরদাচরণ সেই গুতো এড়াতে পারলেন না, তিন হাত শুন্যে ছিটকে উঠে চার হাত দূরে গিয়ে পড়ে চেঁচাতে লাগলেন, “পুলিশ, দমকল, বাবারে!”
হারিকেন অবশ্য আর বরদাচরণের দিকে দৃকপাত করল না। সে চমৎকার লাল আলোয়ানটা দেখে মুগ্ধ হয়ে খুব হাসি-হাসি মুখ করে সেটা মুখে নিয়ে চিবোতে লাগল। যার আলোয়ান, সে ডুকরে উঠে বলতে লাগল, “গেল বার ষাট টাকায় কিনেছিলাম গো! গরুর পেটে আস্ত ষাটটা টাকা ওই চলে গেল।”
কারও সাহস হল না হারিকেনের মুখ থেকে আলোয়ানটা কেড়ে আনবে।
অসম সাহসী গোয়েন্দা বরদাচরণ অনেকটা পথ হামাগুড়ি দিয়ে হেঁটে গিয়ে ইস্কুলের বারান্দায় উঠে বসে কোঁকাতে লাগলেন। আজকের দিনটা তাঁর ভাল যাচ্ছে না। একটা ভুতুড়ে কাকের তাড়া খেয়ে দেওয়াল থেকে পড়েছেন। পিস্তল হারিয়েছেন। ত্যাঁদড় গরুর পাল্লায় পড়ে একেবারে বেহাল হয়েছেন। কিন্তু গুরুতর আহত হয়েও তিনি তাঁর কর্তব্যকর্ম বিস্মৃত হননি। সামান্য একটু দম নিয়েই তিনি হামাগুড়ি দিয়ে চারদিকে ঘুরে সরোজ আর মনোজকে খুঁজতে লাগলেন। তার দৃঢ় ধারণা, কুমার কন্দর্পনারায়ণের দুর্লভ ছবিটার হদিশ ওদের কাছে পাওয়া যাবে।
কিন্তু সরোজ আর মনোজ তখন ইস্কুলের ত্রিসীমানায় নেই। তাদের গরু হারিকেন আজকের ম্যাচ খেলা নষ্ট করেছে, একজনের আস্ত লাল আলোয়ান চিবিয়ে খেয়েছে, বরদাচরণের ক-খানা হাড় ভেঙেছে তা কে জানে! হারিকেন ছাড়া পেলে শহরে তুলকালাম সব কাণ্ড হয়। আর লোকে এসে তাদের গালমন্দ করে, ক্ষতিপূরণ চায়, কয়েকবার পুলিশের কাছেও নালিশ হয়েছে। তাই আজ হারিকেনের কাণ্ড দেখে দুই ভাই কোন ফাঁকে সটকে পড়েছে।
এদিকে বরদাচরণকে হামাগুড়ি দিয়ে ঘুরে বেড়াতে দেখে আবার লোকে ভিড় করে এল। হেড স্যার, ডি এস পি, সিভিল সার্জেন, ছাত্র আর মাস্টারমশাইরা তাঁকে ঘিরে ধরে বোঝাতে লাগলেন, আপনি আহত হয়েছেন বরদাবাবু, এবার একটু বিশ্রাম নিন। ফার্স্ট এইড দেওয়া হবে।
বরদাচরণ বললেন, “ডিউটি ইজ ডিউটি। আমি সরোজ আর মনোজকে এক্ষুনি জেরা করতে চাই। খুব জরুরি দরকার।”
ছেলেরা খবর দিল, ওদের কোথাও খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। হারিকেন ওদেরই গরু কিনা। তাই ওরা লজ্জায় চলে গেছে।
ইতিমধ্যে ডি এস পি থানায় খবর পাঠিয়েছেন, যেন সশস্ত্র পুলিশবাহিনী এসে বদমাশ গরুটাকে গ্রেফতার করে নিয়ে যায়। আলোয়ানওয়ালা লোকটা এসে ক্ষতিপূরণের জন্য ঘ্যানর ঘ্যানর করছে। সমীর আর তিমির বলে বেড়াচ্ছে, হেরে যাওয়ার ভয়ে ক্লাশ এইট গরুটাকে মাঠের মধ্যে তাড়া করে এনেছিল। তাই শুনে তারকবাবু খেঁকিয়ে উঠে বললেন, “ওই গরুটার জন্যই তোমরা এ যাত্রা বেঁচে গেলে। ক্রিকেট খেলার অ-আ-ক-খ-ই এখনও তোমাদের রপ্ত হয়নি।”
ইস্কুলে যখন এইসব কাণ্ড চলছে তখন মনোজদের বাড়ির অবস্থা খুব থমথমে। রাখোবাবু সবাইকে চব্বিশ ঘণ্টা সময় দিয়েছেন, তার মধ্যে হারানো ছবিটা খুঁজে বের করতেই হবে। রাখোবাবু এই কথা ঘোষণা করেই হাতঘড়িটা হাতে পরে নিয়ে মাঝেমাঝে সময় দেখছেন আর বলছেন, “এই তিন ঘণ্টা হয়ে গেল…এই চার ঘণ্টা দশ মিনিট..প্রায় পাঁচ ঘণ্টা…আর মাত্র উনিশ ঘন্টা আছে কিন্তু।”
বাড়িসুদ্ধ লোক ঘরদোর তোলপাড় করে ছবি খুঁজতে লেগেছে। সতীশ ভরদ্বাজ দুপুরবেলা বাড়ি যাওয়ার সময় বলে গেছেন, “আমার হাঁদু-উঁদু থাকলে একলহমায় ছবি-কে-ছবি এমনকি কন্দর্পনারায়ণকেও খুঁজে বের করে কাঁধে বয়ে এনে ফেলত। কিন্তু কী করব, তারা দু মাসের ছুটি নিয়ে দেশে গেছে। নইলে কোনও হাঙ্গামা ছিল না।”
হাঁদু-ভুঁদু হল সতীশ ভরদ্বাজের পোষা ভূত। সবাই তাদের কথা জানে। কেউ অবশ্য তাদের কখনও দেখেনি, কিন্তু সবাই ভয় খায় তাদের।
বৈজ্ঞানিক হারাধন আকাশ থেকে বিদ্যুৎ শক্তি উৎপাদনের একটা নতুন গবেষণায় খুব ব্যস্ত। তামার তার দিয়ে গোটা কুড়ি ঢাউস গ্যাস-বেলুন আধ মাইল উঁচুতে তুলে দেওয়া হবে। সেখানে কোনও একটা স্তরে প্রচুর বিদ্যুতের একটা বলয় রয়েছে। তামার তার বেয়ে সেই বিদ্যুৎ ধরে এনে নানা কাজে লাগানো যাবে বলে হারাধন দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করে। কিন্তু আধ মাইল লম্বা কুড়িটা তামার তার জোগাড় করা চাট্টিখানি কথা নয়। তার ওপর তারগুলো এমন জট পাকিয়ে যায় যে, জট ছাড়াতে গলদঘর্ম।