অফ স্টাম্পের ওপর বলটা ছিল। মনোজ পা বাড়িয়ে ব্যাটখানা পিছনে তুলে বলটার ঠিক ব্ৰহ্মতালুতে ব্যাটখানা দিয়ে চাপড়াল। বলটা মাটিতে একটা ঠোকর খেয়ে স্লিপের মাঝখান দিয়ে সে কি পড়ি মরি দৌড়, যেন পালাতে পারলে বাঁচে।
বাউন্ডারি। হাততালি। চিৎকার। পরের বল মিডল স্টাম্পে, গুড লেংথ। সাধারণত ব্যাটসম্যান এ বল আটকায়। মনোজের এখন আর আটকানোর কথা মাথায় আসছে না। মার না পড়লে সমীরের ধার ভোঁতা হবে না। পিচে পড়ে বলটা ওঠার মুখে, মনোজ এগিয়ে সেটাকে অন ড্রাইভ করল। সমীরের জোরালো বল সে মার সইতে পারল না,
বন্দুকের গুলির মতো মাঠের বাইরে বেরিয়ে গেল।
লাইনের ধারে লোকেরা ভীষণ চেঁচাচ্ছে, ছেলেরা লাফাচ্ছে, স্বয়ং তারকবাবু নিয়ম ভেঙে দু-দুবার মাঠের মধ্যে ছুটে এসেছিলেন, তাঁকে হেডস্যার এসে ধরে নিয়ে গেলেন।
মনোজ এখন আর অন্য কিছু দেখছেও না, শুনছেও না। তার সমস্ত মন চোখ এখন বলের দিকে। একের পর এক বল আসে আর মনোজ এগিয়ে পিছিয়ে, শরীর বাঁকিয়ে নানা কায়দায় কেবল পেটায়। তার মারমূর্তি দেখে সমীরের বল একদম ঝুল হয়ে গেল। দশ ওভারের পর হাঁফাতে হাঁফাতে তার জিভ বেরিয়ে গেছে, মনোজ তখন আশি ছাড়িয়ে গেছে। টোটাল বিরানব্বই। এর মধ্যে শুধু ষষ্ঠীব্রত আউট হয়েছে। আর কোনও ঘটনা ঘটেনি।
মফস্বলের স্কুলের খেলায় লাঞ্চ বা টি হয় না। একনাগাড়ে খেলা চলে। এক ইনিংসের খেলা একদিনেই শেষ হয়ে যায়। দ্বিতীয় ইনিংস বলে কিছু নেই।
কিন্তু ব্যাপার-স্যাপার দেখে মনে হচ্ছিল, ক্লাশ এইট-এর ব্যাটের দাপট আজকে কমবে না। এক ইনিংসও আজ শেষ হবে না।
মনোজ সমীরকে তিন-তিনটে চার মেরে নব্বইয়ের কোঠায় ঢুকে গেল। স্কোরাররা তাল রাখতে পারছে না রানের গতির সঙ্গে।
ওদিকে দর্শকদের মধ্যে একজন কালো চশমা পরা গম্ভীর মানুষ এসে দাঁড়িয়ে আছেন। তাঁর গলায় দূরবীন, কাঁধে ক্যামেরা ঝুলছে। কোমরে পিস্তরের খাপ আছে বটে কিন্তু তাতে পিস্তল নেই। বরদাচরণ মনোজ আর সরোজকে জেরা করতে এসেছেন।
কিন্তু খেলা ভাঙার লক্ষণ দেখা যাচ্ছে না বলে তিনি খুবই বিরক্ত, বার বার ঘড়ি দেখছেন। একবার ধৈর্য হারিয়ে বলেই ফেললেন, “দূর ছাই, ছেলেটা কি আউট হবে না নাকি?”
পাশেই তারকবাবু ঘাসের ওপর বসে জুলজুলে চোখে মনোজের খেলা দেখছেন। বরদাচরণের কথা শুনে তড়াক করে লাফিয়ে উঠে বললেন, “কী! কী বললেন মশাই?”
ল্যাকপ্যাকে রোগা হলেও তারকাবুকে তখন হুবহু খুনির মতো দেখাচ্ছিল।
তারকবাবু খেঁকিয়ে উঠে বললেন, “ইয়ার্কি পেয়েছেন মশাই? ক্রিকেটের মতো সিরিয়াস ব্যাপার নিয়ে ইয়ার্কি? কোন আক্কেলে আপনি ওই অলক্ষুণে কথা বললেন?”
চেঁচামেচিতে মুহূর্তের মধ্যে বরদাচরণের চারধারে ভিড় জমে গেল। স্বয়ং ডি এস পি এগিয়ে এসে বললেন, “আরে! এ যে দেখছি সেই কমিক্যাল গোয়েন্দা ভ ভদ্রলোক! কী করেছেন উনি?”
তারকবাবু আগুন হয়ে বললেন, “ইনি চাইছেন মনোজ আউট হয়ে যাক।” বরদাচরণের কাঁদো কাঁদো অবস্থা। লোকজন চারদিক থেকে আওয়াজ দিচ্ছে। একজন সিটি দিল, অন্যজন বলে উঠল, “ওরে দ্যাখ গোয়েন্দাচরণের পিস্তলের খাপ ফাঁকা!”
বরদাচরণের দূরবীনটা তুলে দূরের জিনিস দেখতে লাগল। সানগ্লাসটা খুলে নিল একজন।
চাকু মামার দুরবস্থা দেখছিল দূর থেকে। সে আরও একটা জিনিস লক্ষ করে রেখেছে। সে লক্ষ করেছে ক্রিকেট মাঠের বাইরে ঘাসজমিতে মনোজদের কুখ্যাত দুষ্ট গরু হারিকেন চরে বেড়াচ্ছে।
চাকু কাউকে কিছু না বলে নিঃশব্দে হারিকেনের দিকে এগিয়ে গেল।
এদিকে মনোজের নিরানব্বই। সমীর সরে গেছে অনেক আগে। একটা আনাড়ি ছেলে বল করতে আসছে। একটা রান অনায়াসে হবে।
ঠিক সেই মুহূর্তে চারদিক থেকে তুমুল চিৎকার উঠল। বোলার ছেলেটা তার দৌড়ের মাঝপথে হঠাৎ বাঁ দিকে ঘুরে প্রাণপণে মাঠের বাইরে ছুট লাগাল। আম্পায়ার অঙ্ক স্যার একটা স্টাম্প উপড়ে বাগিয়ে ধরে তারপর কী ভেবে স্টাম্পটা হাতে করেই দৌড়তে থাকেন।
হতভম্ব মনোজ প্রথমটায় কিছু বুঝতে পারেনি। তারপরই দেখতে পেল, তাদের গরু হারিকেন বাঁ ধারে লাইনের পাশে প্রায় আট-দশজনকে গুঁতিয়ে মাটিতে ফেলে দিয়েছে, তারপর মাঠে ঢুকে দুজন ফিল্ডারকে ধরাশায়ী করে এখন পিচের দিকে ছুটে আসছে। তার মুখে ফেনা, চোখ লাল, ফোঁস ফোঁস শ্বাস ছেড়ে বাঘের গলায় ‘হাম্বা’ ডাক ছাড়ছে।
তার সেই মূর্তি দেখে মুহূর্তে মাঠ ফাঁকা। ডি এস পি, সিভিল সার্জেন, হেডস্যার কে কোথায় গেলেন কে জানে! চারদিকে জড়ামড়ি করে কিছু ছেলে আর লোক পড়ে গেছে মাঠে। হারিকেন মনোজকে চেনে, কাজেই সে মনোজের দিকে দৃকপাত করে সোজা মাঠের লাইনের ধারে দর্শকদের দিকে ছুটে গেল।
বরদাচরণ পিস্তলের খাপে হাত বাড়িয়ে বড় হতাশ হলেন।
তাই তো! হারিকেন আর কাউকে না ধরে কী করে যেন বরদাচরণকেই টারগেট বানিয়ে তেড়ে গেল।
অসমসাহসী বরদাচরণ পালানোর চেষ্টা করেও পারলেন না। দেওয়াল থেকে পড়ে হাঁটুতে চোট। সুতরাং তাঁকে দাঁড়িয়ে থাকতে হল। হারিকেন তেড়ে এসে টু মারতেই বরদাচরণ বাঁ পাশে সরে গেলেন। আবার টু। বরদা আবার ডানপাশে সরলেন। ৬৮
দারুণ জমে গেল খেলা। বরদাচরণ ভারসাস হারিকেন। ক্রিকেটের কথা ভুলে লোকজন বুলফাইট দেখতে আবার ভিড় জমিয়ে ফেলল।