মনোজ রাজি হয়ে গেল।
সেই থেকে তারকবাবু গোপনে মনোজকে তালিম দেন। মাঝে মাঝে বলেন, “তোমার বডি তো খুব ফিট। দমও অনেক। ফাস্ট বোলিং তোমার হবেই।”
সারা স্কুলে মোট পাঁচটা টিম। ফাঁইভ, সিক্স, সেভেন মিলিয়ে একটা টিম, আর চারটে উঁচু ক্লাশের।
ক্লাশ নাইন ক্লাশ এইট ছাড়া বাকি সবাইকে হারিয়ে দিল। ক্লাশ এইট ও নাইন ছাড়া বাকি সবাইকে হারাল; দু ক্লাশের পয়েন্ট সমান। এই দুই ক্লাশের খেলায় যে জিতবে সে-ই চ্যাম্পিয়ন।
সবাই জানে নাইন জিতবে। ইলেভেন-এর বড় ছেলেদের সঙ্গে খেলাতেও নাইন নয় উইকেটে জিতেছিল। সমীর নটা উইকেট পায় মাত্র নয় রানে। তিমির নিরানব্বই করেছিল একা। কাজেই বোঝা যাচ্ছে ক্লাস নাইন কী সাঙ্ঘাতিক টিম।
আজ ফাঁইনাল খেলা। ফাস্ট পিরিয়ডের পর স্কুল ছুটি হয়ে গেল। খেলার মাঠের চারিদিকে দারুণ ভিড় আর ধাক্কাধাক্তি। মাঝের মাঝখানে তিনটে করে ছটা স্টাম্প গাড়া হয়ে গেছে। স্বয়ং সিভিল সার্জেন, ডি এস পি আর মুনসেফ খেলা দেখতে এসেছেন। তাঁদের জন্য আলাদা চেয়ারের ওপর ছোট ত্রিপল টাঙানো হয়েছে। ক্রেট বোঝাই লেমোনেড এসেছে মাঠে। চানাচুর, ঝালমুড়ি, ফুচকা আর আইসক্রিমের গাড়ি জড়ো হয়েছে। বেশ মেলা-মেলা ভাব।
তারকবাবু প্রচণ্ড উত্তেজনায় ছোটাছুটি করছেন।
এইট-এর ক্যাপটেন মনোজ আর নাইন-এর ক্যাপটেন সমীর মাঠে নেমে টস করল।
টসে জিতে গেল মনোজ। বিনা দ্বিধায় বলল, “ব্যাট।”
সমীর একটু কাঁধ ঝাঁকাল মাত্র।
ওয়ান ডাউনে মনোজ নামবে। ওপেনিং ব্যাটসম্যান দুজন মাঠে রওনা হয়ে যেতেই তারক স্যার এসে বললেন, “মনোজ প্যাড-আপ করো। এক্ষুনি উইকেট পড়বে।”
মনোজ প্যাড বাঁধতে বাঁধতে বলল, “একঘণ্টা টিকতে পারলে হয়।”
তারক স্যার নিজে প্রচণ্ড উত্তেজিত। তবু বললেন, “উত্তেজিত হয়ো না মনোজ। আমি জানি সমীরের সুইং নেই। কিন্তু অসম্ভব জোরে বল আসে বলে আনাড়িরা খেলতে পারে না, লাগার ভয়ে আউট হয়ে চলে আসে। তুমি ঘাবড়াবে না।”
স্যারের কথাই ঠিক। মাঠে নামতে না নামতে ওপেনিং ব্যাট গদাইচরণ সমীরের দ্বিতীয় বলে বোলড হয়ে ফিরে এল।
মনোজ যখন নামছে তখন ক্লাশ এইট-এর ছেলেরা খুব হাততালি দিল। সমীর দূর থেকে বলটা লোফালুফি করতে করতে একটু তাচ্ছিল্যের হাসি হাসল। তারকবাবু মনোজের পাশাপাশি হাঁটতে হাঁটতে মাঠের মধ্যে খানিকদূর এলেন, বার বার বললেন, “সোজা বল, খেলতে অসুবিধা নেই। প্রথম থেকেই একটু মেরে খেললে দেখবে ও কাবু হয়ে গেছে।”
যদিও মনোজ খুব সাহসী ছেলে তবু এখন তার হাত-পা একটু ঝিম ঝিম করছিল! হাঁটুর জোরটা যেন কমে গেছে, হাতে ব্যাটটা বেশ ভারী-ভারী লাগছে।
গার্ড নিয়ে দাঁড়িয়ে চারদিকে ফিলডারদের অবস্থান দেখতে একটু সময় নিল মনোজ। ভয় করছে। বেশ কয়েকবার বুকটা দুরদুর করে ওঠে।
সমীর ওভারের তৃতীয় বলটা দিতে প্রায় স্ক্রিনের কাছাকাছি চলে গেছে। অত দূর থেকে দৌড়ে এসে বল করলে সে বল যে কী মারাত্মক জোরের বল হবে তা ভাবতেই মনোজের পেটটা গুলিয়ে উঠল।
চারদিকের মাঠ স্তব্ধ। সমীর জেট প্লেনের মতো দৌড়ে আসছে। এসে বাঁই করে হাত ঘোরাল।
বলটা একবার দেখতেও পেল না মনোজ। একটা আবছা লাল ফিতের মতো কী যেন সড়াক করে পিচের ওপর দিয়ে বেরিয়ে গেল। বেকুবের মতো মনোজ দাঁড়িয়ে থাকে। স্লিপের ফিলডাররা হাসছে।
আবার সমীর দৌড়ে আসে। বল করে। আবার সেই লাল ফিতের মতো লম্বাটে একটা ছায়া দেখতে পায় মনোজ। কিন্তু এমন সাঙ্ঘাতিক তার গতি যে ব্যাটটা তুলবারও সময় হয় না।
মনোজের ভাগ্য ভাল যে, দুটো বলই ছিল বাইরের।
সে আবার ব্যাট আঁকড়ে কুঁজো হয়ে দাঁড়ায়। কিন্তু হাত পা ঝিম ঝিম করে, চোখে অন্ধকার-অন্ধকার লাগে। স্ক্রিনের কাছ থেকে সমীর ক্ষ্যাপা ষাঁড়ের মতো দৌড়ে আসছে।
মনোজের একবার দৌড়ে পালিয়ে যাওয়ার ইচ্ছে হল। অনেক কষ্টে সে ইচ্ছে দমন করে প্রাণপণে চোখ দুটো বিস্ফারিত করে সমীরের বল করার কায়দাটা দেখতে লাগল।
সমীরের হাত যখন ঘঘারে তখন ঠিক সিলিং ফ্যানের মতো ঘূর্ণমান চক্রের মতো দেখায়।
এবার লাল ফিতেটা বাইরে দিয়ে গেল না। সোজা চলে এল মনোজের দিকে। গুড লেংথে পড়ে মিডলস্টাম্পে।
মনোজ ব্যাট তোলেনি, হাঁকড়ায়নি, কিচ্ছু করেনি। বলটা এসে আপনা থেকেই ব্যাটটাকে একটা ঘুষি মেরে অফ-এর দিকে গড়িয়ে গেল।
একটা বল আটকেছে মনোজ, তাইতেই হাততালি পড়ল চারদিকে।
সমীর শেষ বলটা করতে আসছে। একইরকম গতিবেগ। তবে এখন মনোজের অতটা ভয় করছে না।
এ বলটাও সোজা এল। একটু শর্ট পিচ পড়ে কোমর সমান উঁচু হয়ে লেগ-এর দিকে বেরিয়ে যাচ্ছিল। মনোজ ব্যাটটা দিয়ে খুব তাড়াতাড়ি ভেগে-যাওয়া বলটা জোর চাপড়ে দেয়। সেই চাপড়ানিতে বলটা আরো দিগ্বিদিক জ্ঞানশূন্য হয়ে একলাফে বাউন্ডারি ডিঙিয়ে আরও পঞ্চাশ গজ দূরে গিয়ে পড়ল। ছক্কা।
হাততালির তুমুল শব্দে কানে তালা লাগবার জোগাড়।
পরের ওভারে বল করল সোজ। এইট-এর ওপেনিং ব্যাট ষষ্ঠীব্ৰত সে ওভারটা খুটখাট করে কাটিয়ে দিল। রান হল না।
পরের ওভারে আবার সমীর বল করতে আসে, মনোজ ব্যাট করবে।
চারিদিক থেকে চিৎকার ওঠে, “মনোজ আর একটা ছক্কা চাই।”
আগের ওভারে একটা ছক্কার মার খেয়ে সমীরের শরীরে আগুন লেগে গেছে। সে তিনগুণ জোরে দৌড়ে এসে যে বলখানা দিল তা অ্যাটম বোমের মতো। কিন্তু মনোজের বুকের দুরদুরুনিটা এখন নেই। হাত-পাও বেশ বশে এসে গেছে। চোখেও কিছু খারাপ দেখছে না।