এই বলে রাখোবাবু উঠে যাচ্ছিলেন।
বরদাচরণ বললেন, “সবটা শুনুন রাখোবাবু, তারপর না হয় তুচ্ছ-তাচ্ছিল্য করবেন।”
সতীশ ভরদ্বাজও বললেন, “হ্যাঁ, হ্যাঁ, সবটা শোনা উচিত।”
রাখোবাবু মুখটা বিকৃত করে বললেন, “আপনি কী বলতে চান বরদাবাবু যে রাজার মা খুঁটে দেয়, যার রানী কচুর শাক তোলে এবং যে রাজা নিজে শশা খায় সে পাঁচশো টাকায় গোয়েন্দা ভাড়া করবে আর একটা ছবির জন্য হাজার টাকা পুরস্কার দেবে, এটা বিশ্বাসযোগ্য?”
বরদাচরণ অত্যন্ত উদ্বিগ্ন হয়ে বলেন, “শুনুন রাখোবাবু। রাজার মা যে খুঁটে দেন সেটা অভাবে নয়। সময় কাটানোর জন্যই তিনি খুঁটে দেন। রানী অম্বিকা কচুর শাক তুলছিলেন বটে, কিন্তু তার মানে এ নয় যে তাঁদের অন্য তরকারি জোটে না। আসলে গোবিন্দনারায়ণের কচুর শাকের ওপর খুব রাগ। কিন্তু রানী নিজে কচুর শাক ভালবাসেন বলে চুপি-চুপি নিজেই তুলে নিয়ে গোপনে রান্না করে খান। আর শশা? হাঃ হাঃ। গোবিন্দনারায়ণের ডায়াবেটিস হওয়ার পর থেকে ডাক্তার তাঁকে কেবল শশা খেয়েই থাকতে বলেছেন যে! শশার মধ্যে চিনির ভাগ খুবই কম। আর এ তো সবাই জানে গোবিন্দনারায়ণের রাজত্ব এখন না থাকলেও রাজবাড়ির হাজারটা সুড়ঙ্গ দিয়ে মাটির তলায় যে সব চোর কুঠুরিতে যাওয়া যায় সেখানে লক্ষ লক্ষ টাকার হীরে জহরত আর মোহর রয়েছে! অবিশ্বাস করবেন না রাখোবাবু, আমি এরকম একটা চোর কুঠুরিতে নিজে একবার ঢুকেছিলাম।”
সতীশ ভরদ্বাজ বলে উঠলেন, “সত্যি বলছ বাবা বরদাচরণ?”
“আমি মিথ্যে বলি না,” বরদাচরণ গম্ভীরভাবে বলেন। সতীশ ভরদ্বাজ বলেন, “তা হলে একবার আমার বাড়ি যাও তো। মনে পড়ছে, আমার বাড়ির কুলুঙ্গিতে একটা ছোট্ট ন্যাংটো ছেলের হামা-দেওয়া ছবি আছে। আমার ব্রাহ্মণী আবার সেটাকে গোপালের ছবি ভেবে পুজো-টুজো করেন। একবার দেখো তো সেই-ছবিটাই নাকি?”
ঠাকুরমশাইয়ের কথায় কেউ কান দিল না।
বরদাচরণ বললেন, “রাখোবাবু, গত বছর আপনার বাড়ির সামনের বাগান থেকে সরস্বতী পুজোর আগের দিন রাত্রে অনেক ফুল ও ফল চুরি যায়, খবর পেয়ে এসে আমি তদন্ত করে বের করি যে, সে সব ফুল ও ফল চব্বিশ পল্লীর ছেলেরা তাদের পুজোর জন্য চুরি করেছিল। মনে আছে?”
রাখোবাবু রেগে গিয়ে বলেন, “তাতে মাথা কিনেছিলেন, আর কি! ধরে লাভটা কী হয়েছিল? তারা তো সে সব ফুল-ফল আমার গাছে এসে আবার লাগিয়ে দিয়ে যায়নি!”
বরদাচরণ গম্ভীরভাবেই বললেন, “এবং ওরা চুরি কেন করেছিল তাও আমি বের করেছিলাম। আপনি সেবার ওদের চাঁদা দেননি।”
রাখোবাবু রেগে গিয়ে বলেন, “কেন দেব? চব্বিশ পল্লীর পুজো আপনার পাড়ায় হয়। বেপাড়ার পুজোর চাঁদা দেব কেন? আর এও বলে রাখছি, সে চুরির পেছনে আপনার হতচ্ছাড়া ভাগনে। ওই চাকুও ছিল।”
বরদাচরণ বললেন, “শুনুন রাখোবাবু, উত্তেজিত হবেন না। আমি সেই চুরির ব্যাপার আলোচনা করতে আসিনি।”
“তা হলে কী জন্য এসেছেন?”
“যখন আমি এ বাড়িতে সেই চুরির ব্যাপারে তদন্ত করছিলাম তখন হঠাৎ আমার খুব জলতেষ্টা পায়। আমি পুতুলের কাছে এক গ্লাস জল চাই। পুতুল তখন এই বারান্দায় বসে একটা ছবির অ্যালবাম খুলে তার এক বন্ধুর সঙ্গে বসে ফোটোগুলো দেখছিল। সে অ্যালবাম রেখে জল আনতে গেল, তখন আমি আনমনে অ্যালবামটা তুলে ছবিগুলো দেখছিলাম। তার মধ্যে একটা খুব সুন্দর চেহারার ছেলের ছবি ছিল। ছেলেটা একটা বাংলো বাড়ির সামনের সিঁড়িতে বসে আছে, তার পাশে একটা কাঁচের গ্লাসে দুধ রয়েছে। দুধটা একটা বেড়াল খেয়ে নিচ্ছে…মনে পড়ছে আপনার? পুতুল জল নিয়ে এলে আমি তাকে ওই ছবিটা কার তা জিজ্ঞেস করায় সে বলতে পারল না। আমি তখন মনোজ, সোজ এবং ভজবাবুকেও জিজ্ঞেস করি। তারা কেউ কিছু বলতে পারেনি। কিন্তু ছেলেটা দেখতে এত সুন্দর এবং ছবিটা এত রহস্যময় যে আমি ব্যাপারটা ভুলতে পারিনি। আজ ছবিটার কথা মনে পড়ে গেল। কিছু যদি মনে করেন তো আপনাদের ছবির অ্যালবামটা একটু আনুন, আমার খুব সন্দেহ হচ্ছে ওই ছবিটাই কুমার কন্দর্পনারায়ণের।”
রাখোবাবু একটু হাঁ করে থেকে বলে উঠলেন, “তাই তো বরদাবাবু! তাই তো!” বলেই হঠাৎ উঠে চেঁচাতে লাগলেন–”রামু, রঘু, কিরমিরিয়া জলদি অ্যালবাম আন। জলদি।”
ডাক শুনে কিরমিরিয়া রান্নাঘর থেকে বেরিয়ে এসে ডুকরে কেঁদে উঠল, “ও দাদাবাবু গো, আমি কিছু জানি না গো! আমি কিছু করিনি গো!”
রঘু ‘জলদি’ শুনতে ‘জল’ শুনে এক গ্লাস জল নিয়ে পড়িমরি করে দৌড়ে এল। আর রামু তাড়াতাড়ি বাড়ির পিছনে গিয়ে লুকল।
যাই হোক, অনেক চেঁচামেচি, খোঁজাখুঁজির পর অ্যালবামটা পাওয়া গেল।
হাঁফাতে হাঁফাতে রাখোবাবু অ্যালবাম এনে পাতা খুলে ছবিটা খুঁজতে লাগলেন। খুঁজতে-খুঁজতে একটা পাতায় দেখা গেল ছবিটা যে-চারটে স্টিকারে লাগানো ছিল তা লাগানোই আছে, কিন্তু ছবিটা নেই।
রাখোবাবু হতাশ হয়ে বসে বললেন, “সর্বনাশ!”
বরদাচরণ অ্যালবামটা তুলে নিয়ে দেখলেন। মুখখানা অসম্ভব গম্ভীর হয়ে গেল। হঠাৎ আস্তে করে বললেন, “রাখোবাবু, এখন আমার আর কিছুমাত্র সন্দেহ নেই যে এ ছবিটাই ছিল কন্দর্পনারায়ণের ছবি।”
সতীশ ভরদ্বাজ বলে ওঠেন, “আমার ঘরে যে বালগোপালের ছবিটা আছে, বুঝলে বাবা বরদা, সেটাও–”
বরদাচরণ সতীশ ভরদ্বাজকে পাত্তা না দিয়ে বললেন, “অ্যালবাম থেকে ছবিটা চুরি যাওয়াতেই ব্যাপারটা দিনের আলোর মতো স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছে। অ্যালবামটা আমি নিয়ে যাচ্ছি রাখোবাবু, ফিঙ্গারপ্রিন্টগুলো দেখতে হবে। আর বাড়ির সবাইকে জিজ্ঞাসাবাদও করা দরকার।”