কাকমারা ভুলে গিয়ে সরোজ মনোজ পুতুল তখন হাঁ করে দেখছে, গোয়েন্দা বরদাচরণ আর চাকু দেয়ালের ওপর উঠে দাঁড়িয়েছে।
দুজনের দেয়াল টপকানো দেখে অবশ্য অবাক হওয়ার কিছু নেই। সাধারণত গোয়েন্দা বরদাচরণ কখনও সদরদরজা দিয়ে ঢোকেন না। তাতে নাকি গোয়েন্দার বৈশিষ্ট্য নষ্ট হয়ে যায়, লোকে গোয়েন্দা বলে খাতির করে না। গোয়েন্দাদের আচার-আচরণে একটা রহস্যময়তা না থাকলে লোকে সেই গোয়েন্দাকে মানবেই বা কেন? গোয়েন্দারা কখনও সহজ পথে চলবেন না, সহজ পথে ভাববেন না, সহজ চোখে চাইবেন না। সব সময়ে এমন আচরণ করবেন যাতে লোকে চমকে, আঁতকে, ভয় খেয়ে বা ভিরমি খেয়ে যায়। তাই গোয়েন্দা বরদাচরণ বেশির ভাগ বাড়িতেই দেয়াল টপকে, জানালার শিক বেঁকিয়ে ঢোকেন। শোনা যায়, এক বাড়িতে নাকি সিঁধ কেটেও ঢুকেছিলেন।
তবে চেনাজানা লোকের বাড়ি না-হলে তিনি এতটা করেন না।
যাই হোক, বরদাচরণ দেয়ালের ওপর উঠে গলা থেকে ঝোলানো একটা বাইনোকুলার তুলে চোখে লাগিয়ে চারদিক দেখছিলেন। তাঁর সেই দেখা আবার দেখছিল সরোজ, মনোজ পুতুল, সতীশ ভরদ্বাজ। আর ঠিক সেই সময়ে স্নানের ঘর থেকে বেরিয়ে ঠাকুরঝি ভেজা পায়ে আর একবার পড়ি-পড়ি করেও সামলে গিয়ে দাঁড়িয়ে চাকু আর বরদাচরণকে দেখতে পেলেন।
রাখোবাবু কাকটার ব্যবহারে বিরক্ত হয়ে চেঁচিয়ে বললেন, “কেউ কি নেই যে কাকটাকে এক জায়গায় একটু ধরে রাখবে স্থির করে?”
কাকটার খাওয়া হয়ে গেছে। এবার সে একটা উড়াল দিয়ে ফের পেঁপে গাছটায় বসল। রাখোবাবু বললেন, “এই বার। এইবার!”
বলতে বলতে পেঁপে গাছের দিকে কাকটাকে টিপ করতে গিয়ে তিনি দেয়ালের ওপর মামা-ভাগ্নের মূর্তি দেখে চমকে প্রচণ্ড চেঁচিয়ে বললেন, “কে রে? অ্যাাঁ? কার এই সাহস যে দেয়ালে উঠেছিস?”
তাক করা গুলতি দেখে, আর সেই গর্জন শুনে তৎক্ষণাৎ চাকু পচাং করে দেয়ালের ওপিঠে লাফিয়ে পড়ল। বরদাচরণ তা পারলেন না। চাকু ছেলেমানুষ, সে হালকা শরীরে যত লাফঝাঁপ করতে পারে, বরদাচরণ তা পারেন না। এ বয়সে লাফ-টাফ দিলে হাত-পা ভাঙতে পারে। তবে তিনি বাইনোকুলারটা ফেলে দুটো হাত ওপর দিকে তুলে বলে উঠলেন, “সারেন্ডার! গুলতি ছুড়বেন না। আমি বরদাচরণ।”
“ও বরদাবাবু।” বলে রাখোবাবু গুলতি নামিয়ে নিলেন। বললেন, “কী খবর?”
“খবর খুব সাঙ্ঘাতিক, আমি একটা তদন্তে এসেছি।”
“তদন্ত! কিসের তদন্ত মশাই?”
“বলছি।” বলে বরদাচরণ দেয়াল থেকে নামবার উপায় খুঁজতে থাকেন। দেয়ালটা মস্ত উঁচু, চাকু লাফ দিলেও বরদাচরণ তা করতে ভরসা পান না। তাই খুব সাবধানে দেওয়ালের ওপর দিয়ে হেঁটে পেঁপে গাছটার কাছবরাবর যেতে থাকেন। ইচ্ছে, পেঁপে গাছ বেয়ে নেমে আসবেন।
সতীশ ভরদ্বাজ বলে ওঠেন, “উঁহু, উঁহু, বড় নরম গাছ ভেঙে যাবে। গাছে আবার কাকভূতও বসে আছে।”
“রাখোবাবু বললেন, “ভূত নয়। কাক।”
সতীশ ভরদ্বাজ বললেন, “ভূত।”
“কাক।”
“ভূত।”
“কাক।”
“ভূত।” কিন্তু মীমাংসা হল না বলে দুজনেই দুজনের দিকে খানিক কটমট করে চেয়ে রইলেন।
ওদিকে, বরদাচরণ কাকটার কথা জানতেন না, পেঁপে গাছের সহনশীলতা সম্পর্কেও তাঁর জ্ঞান নেই। যেই পেঁপে গাছের ডগাটা ধরতে গেছেন অমনি ভুতুড়ে কাকটা বলে উঠল, “খাওরখার।“
“উঁ।” সতীশ ভরদ্বাজ বলেন, “শুনলেন তো! পরিষ্কার বলল–খবরদার।”
রাখোবাবু বলেন, “ওটা কাকের ডাক।”
বরদাচরণ কাকটাকে বললেন, “হুঁশ! হশ?”
কাক বলল, “ক্যা?”
বরদা বললেন, “চোপরাও কেলেভূত। পালা! যাঃ, যাঃ!”
কাক বলল, “কটর, কটর।”
সতীশ ভরদ্বাজ বললেন, “শুনুন। বলছে, কেটে পড়, কেটে পড়।”
বরদাচরণ তখন ট্যাঁক থেকে রিভলবার বার করে ফেলেছেন। কাকটাকে শাসিয়ে বললেন, “দেব খুলি উড়িয়ে? যাঃ বলছি!”
কাকটা হুড়শ করে উঠে বরদাচরণের মাথায় একটা রাম-ঠোক্কর মারল। বরদাচরণ পেঁপে গাছের ডগাসুষ্ঠু ভেঙে নিয়ে হড়াস করে উঠোনে পড়লেন। সেই শব্দে বাড়িময় দৌড়োদৌড়ি চেঁচামেচি পড়ে গেল।
বামাসুন্দরী এসে বরদাচরণকে হাত ধরে তুলে বললেন, “কেন বাবা বরদা, সামনে সদর-দরজা থাকতেও দেয়াল টপকাতে গেলে?”
বরদাচরণ নিজের কোমর হাত দিয়ে মালিশ করতে করতে ব্যথার মধ্যেও বললেন, “তাতে কী মাসিমা, গোয়েন্দাদের কত রিস্ক নিতে হয়! এ তো দেয়াল থেকে পড়া দেখলেন, সিমলায় একবার পাহাড় থেকে পড়তে হয়েছিল। চলন্ত ট্রেন বা মোটর থেকেও কতবার লাফ দিয়েছি। গোয়েন্দাদের ব্যথা লাগে না।”
কাকটা আবার দেয়ালে বসেছে, গলায় পৈতে। বামাসুন্দরী তাকে আর-একবার নমস্কার করে ঘরে চলে গেলেন। রাখোবাবুও গুলতিটা নামিয়ে নিয়ে বললেন, “না, এ কাকটা খুবই ডেঞ্জারাস দেখছি! গুলতি মারলে হয়তো আবার রিভেঞ্জ নিতে তেড়ে আসবে।”
“তবে?” বলে সতীশ ভরদ্বাজ খুব সবজান্তা হাসি হাসলেন। বললেন, “সাক্ষাৎ ব্রাহ্মণভূত।”
বরদাচরণের পিস্তলটা ছিটকে পড়েছিল জবা গাছের গোড়ায়। সরোজ সেটাকে কুড়িয়ে সুট করে মনোজের হাতে চালান দিল। মনোজ জামার তলায় লুকিয়ে নিয়ে পুতুলের হাতে পাচার করল। পুতুল সেটা নিয়ে নিজের পুতুলের বাক্সে ন্যাকড়া চাপা দিয়ে লুকিয়ে রেখে ভালমানুষের মতো মুখ করে ঘর থেকে বেরিয়ে এল।
বরদাচরণের অবশ্য পিস্তলটার কথা খেয়াল হল না। পড়ে গিয়ে তাঁর ঘিলু নড়ে গেছে, মাথা ঝিমঝিম করছে। নিতান্ত গোয়েন্দাদের অজ্ঞান হতে নেই বলে তিনি অজ্ঞান হননি। একটু খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে এসে তিনি বারান্দায় রাখোবাবুর মুখোমুখি বসে বললেন, “ব্যাপারটা খুবই জরুরি এবং গোপনীয়। আমি একটা পুরনো ফোটোগ্রাফের সন্ধানে আপনার বাসায় এসেছি। একটা ছোট ছেলের ফোটোগ্রাফ।”
৩. বরদাচরণের পড়ে যাওয়ার শব্দে
বরদাচরণের পড়ে যাওয়ার শব্দে দুঃখবাবু আর গণেশ ঘোষালও ছুটে এসেছিলেন। তেমন কিছু হয়নি দেখে তাঁরা হতাশ হলেন।