লম্বা-চওড়া লোক দেখলে আজকাল সুধীরের করুণাই হয়। বেচারারা জানে না, লম্বা হয়ে কী ভুলটাই না করেছে।
বেশ আনন্দেই ছিল বটে সুধীর। কিন্তু তার মতো মনিষ্যিদের একটা দিন ভাল যায় তো পরের দিনটাই খারাপ। আজ পুন্নিমে তো কালই অমাবস্যা। মন্টুরামের হাতে হেনস্থা হওয়ার পর থেকে সবাই দুয়ো দিচ্ছে তাকে। এমন কথাও বলছে যে, আলমারির মধ্যে দম বন্ধ হয়ে মরে গেলেও নাকি সে শহিদের সম্মান পেত আর মোটা ক্ষতিপূরণও আদায় হত। না মরে বড়ই ভুল করে ফেলেছে সে। কালোবাবু তাকে কাজ থেকে ছাড়িয়ে দিয়েছেনই, আগামের হাজার টাকাও ফেরত চেয়েছেন। ফেরত না দিলে যে কী হবে, তা ভাবতেও হাত-পা হিম হয়ে আসে। তাই আজকাল সুধীরের ঘনঘন দীর্ঘশ্বাস পড়ে। খিদে হয় না, ঘুম হয় না, বেঁটে হওয়ার দরুন যে আনন্দটা হত, সেটাও হয় না। লাইনের বন্ধুবান্ধবরা আগে খোঁজখবর নিত, তারাও মুখ ফিরিয়ে নিয়েছে।
এমনকী, কানাই দারোগা পর্যন্ত তাকে থানায় ডেকে নিয়ে গিয়ে বলল, “ওরে চোর-পুলিশের সম্পর্কটা তো আজকের নয়, হাজার হাজার বছরের পুরনো সম্পর্ক। চোর ছাড়া যেমন পুলিশের চলে না, তেমনি পুলিশ ছাড়া চোরের মহিমা থাকে না। বুঝলি? সম্পর্কটা অনেকটা বাপ-ব্যাটার মতো। আবহমান কালের ব্যাপার। তাই তোর ভালর জন্যই বলি, বিদ্যেটা একটু ভাল করে ঝালিয়ে নিয়ে তবে কাজে নামিস বাবা! মন্টুরাম তোর নামে একটা ডায়েরি করে রেখেছে বটে, তবে তুই কাঁচা চোর বলে আমি কেস দিচ্ছি না।”
এ কথা শুনে সুধীরের ভারী আবেগ এসে পড়ায় সে হাউহাউ করে কেঁদে উঠে বলল, “আর চুরিটুরি করব না বড়বাবু।”
তাতে কানাই দারোগা ভারী অবাক হয়ে বলল, “চুরি করবি না! চুরি করবি না কেন রে? চুরি না করলে তোরই বা চলবে কী করে, আমাদেরই বা চলবে কী করে? বলছি কী, হাত মকশো করে নিয়ে কাজে লেগে যা। আর পুলিশের সঙ্গে যে তোর বাপ-ব্যাটার সম্পর্ক, সেটা ভুলিস না। খোরপোশ বাবদ কিছু করে দিয়ে যাস বাবা।”
“যে আজ্ঞে।”
“এখন যা বাবা, আমার বাড়ির কাজের মেয়েটা তিনদিন ছুটি নিয়ে দেশে গিয়েছে। এই তিনটে দিন ঘরের ছেলের মতো আমার বাড়ির কাজগুলো করে দে। বেশি কিছু নয় রে, ঘরদোর ঝাড়পোছ করবি। কাপড়চোপড় কেচে দিবি আর বাসনগুলো মেজে দিবি। আর ওই সঙ্গে বাগানটাও একটু কুপিয়ে দিস বাবা।”
এটা যে আরও বড় অপমান, সেটাও সুধীর হাড়ে হাড়ে টের পেল। এর চেয়ে জেল খাটলেও সেটা সম্মানের ব্যাপার হত। অপমানে অপমানে সে যেন আরও বেঁটে হয়ে যাচ্ছে। কিন্তু বেঁটে হওয়ার আনন্দ টের পাচ্ছে না।
চৈতন্যপুরের খালধারে বাঁধানো বটতলায় একটা গামছা পেতে শুয়ে নিজের দুঃখের কথাই ভাবছিল সুধীর গায়েন। ভাবতে ভাবতে একটু তন্দ্ৰামতো এসে গিয়েছিল। এমন সময় টের পেল, তার শিয়রের কাছে কে যেন এসে সাবধানে বলল, “কালোবাবু নয় তো!” কালোবাবু এমনি ভাবেই হঠাৎ-হঠাৎ যেন মাটি খুঁড়ে হাজির হয়ে যান, কখনও যেন বাতাস থেকে শরীর ধরেন। কখন কোথায় হাজির হবেন, তার ঠিক নেই। কালো কাপড়ে মুখ ঢাকা ওই মূর্তিকে দেখলে তার অন্তরাত্মা শুকিয়ে যায়। তাই সুধীর জোর করে চোখ বন্ধ রেখে মটকা মেরে পড়ে রইল।
শিয়রের কাছে বসা লোকটা যেন উসখুস করল কিছুক্ষণ। তারপর হঠাৎ বলে উঠল, “উঃ! এখানে বড্ড চোর চোর গন্ধ পাচ্ছি।”
কথাটা শুনে সুধীর টক করে উঠে বসল। খিঁচিয়ে উঠে বলল, “চোর চোর গন্ধ পাচ্ছেন মানে! গন্ধ পেলেই হল? চোরের গায়ে কি আলাদা গন্ধ থাকে নাকি?”
বুড়োসুড়ো লোকটা ধুতির খুঁটে নাক চেপে ছিল। জুলজুল করে সুধীরের মুখের দিকে চেয়ে থেকে বলল, “তা থাকে বই কী বাপু। চোরের গন্ধ আমি খুব চিনি। একটু চামসে গন্ধ। কাঁচা চামড়া রোদে দিলে যেমনটা হয়। তা বাপু, তুমি কি চোর নাকি?”
সুধীর গম্ভীর মুখে মাথা নেড়ে বলল, “না। চুরি ছেড়ে দিয়েছি।”
লোকটা যেন একটু আঁতকে উঠল, তারপর ভারী অবাক হয়ে বলল, “বলো কী? ছেড়ে দিয়েছ?”
“হ্যাঁ। ও কর্ম আমার জন্য নয়।”
“ছেড়ে দিয়েছ, কিন্তু গন্ধ যে একেবারে ম ম করছে হে!”
“মোটেই আমার গায়ে কোনও চামসে গন্ধ নেই। আমি রোজ গায়ে মাটি মেখে চান করি।”
“ও কি আর গায়ের গন্ধ হে! ও হল গুণের গন্ধ, সবাই কি ও গন্ধ টের পায়?”
সুধীর একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলে, “গুণ-টুন আমার নেই মশাই। আমি ঠিক করেছি, এই বটতলাতেই একটা তেলেভাজার দোকান দেব।”
লোকটা চাপা আর্তনাদ করে উঠল, “সর্বনাশ! এত ক্ষমতা, এত বুদ্ধি, এত এলেম নিয়ে শেষে তেলেভাজার দোকান! এ যে হাতি দিয়ে হালচাষ! গদা দিয়ে পেরেক পোঁতা! পুকুরে জাহাজ ভাসানো?”
সুধীর একটু ভড়কে গিয়ে বলে, “মানেটা কী দাঁড়াচ্ছে বলুন তো মশাই! আপনি কি সাঁটে কিছু বলতে চাইছেন?”
লোকটা একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে ডাইনে-বাঁয়ে মাথা নেড়ে হাল-ছাড়া গলায় বলে, “মৃগনাভির কথা শুনেছ তো! কোটিতে গুটিক মেলে। কত লোক মৃগনাভির খোঁজে হন্যে হয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছে, কিন্তু সেই হরিণ খুঁজে পাওয়া ভারী কঠিন কাজ। বুঝলে?”
“বুঝলুম মশাই। কিন্তু মৃগনাভিতে আমাদের কী প্রয়োজন?”
“তা ধরো কেন, আমি আজ সেই দুষ্প্রাপ্য মৃগনাভির হরিণই খুঁজে পেয়েছি। চামসে গন্ধ শুনে তুমি রাগ করলে বটে, কিন্তু ওই চামসে গন্ধওলা লোক খুঁজে খুঁজে কত মানুষ যে হয়রান হয়ে যাচ্ছে, তা জানো?”