একগাল হেসে হিরু বলে, “আজ্ঞে, লোহালক্কড়ের ঘরে একটা টিনের বড় বাক্সে পুরনো জিনিসপত্রের মধ্যে পড়েছিল রাজামশাই। মরচে পড়ে গিয়েছে বটে, কিন্তু খাঁটি বিলিতি জিনিস। মেহনত করে ঘষে-মেজে নিলে এতে এখনও কাজ হয়। এসব জিনিস কি অযত্নে ফেলে রাখতে হয় কর্তা?”
হরিশ্চন্দ্র দুশ্চিন্তাগ্রস্ত মুখে বললেন, “ওই বন্দুক আমার বাপ ঠাকুরদা চালাতেন বটে, আজকাল আর দরকার হয় না বলে পড়ে আছে।”
হিরু বন্দুকটার গায়ে আদর করে একটু হাত বুলিয়ে বলল, “যা দিনকাল পড়েছে কর্তামশাই, তাতে কোথা দিয়ে কোন বিপদ আসে তার ঠিক কী? একটা অস্ত্র থাকা তো ভালই।”
হরিশ্চন্দ্র প্রমাদ গুনে বললেন, “ওরে বাপু, ওইসব বিপজ্জনক জিনিস ঘাঁটাঘাঁটি করা মোটেই ভাল কথা নয়। ওতে আমাদের কাজ কী?”
“তা হলে খুলেই বলি রাজামশাই, এই হিরু গণপতির পিছনে পিছনেই বিপদ ঘোরে। এই তো দু মাস আগে মনসাপোতার জঙ্গলে কালোবাবুর দল আমাকে প্রায় মেরেই ফেলেছিল। তারপর ফুটু সর্দারও আমার সন্ধানে ঘুরে বেড়াচ্ছে শুনেছি।”
আতঙ্কিত হরিশ্চন্দ্র বললেন, “কেন বাপু, তুমি করেছটা কী?”
“সে অনেক কথা রাজামশাই। তবে আমি যখন এসে পড়েছি, তখন বিপদের অভাব হবে না।”
৩. বাঁকা মহারাজকে ভয়
পাথরপোতার বাঁকা মহারাজকে ভয় খায় না, এমন লোক কাছেপিঠে পাওয়া ভার। তার কারণও আছে। বাঁকা মহারাজ হয়কে নয় করতে পারেন, কালোকে সাদা, দিনকে রাত করলেন তো পুন্নিমেকে অমাবস্যা। বাঁকা মহারাজের মহিমা শুনে শুনে কয়েক বছর আগে সুধীর গায়েন মহারাজের নজরানা বাবদ পঞ্চাশটা টাকা কোনওমতে জোগাড় করে পাথরপোতায় গিয়ে হাজির হয়েছিল।
একেবারে পা জড়িয়ে ধরে বলেছিল, “বাবা, বেঁটে বলে কেউ পাত্তা দেয় না, মান্যিগণ্যি করে না, ভাল করে তাকিয়েও দ্যাখে না। মনে বড় কষ্ট বাবা। অন্তত ছয় ফুট লম্বা করে দিন। এই তো সেদিন ভজনবাবুর বাড়িতে গিয়ে কড়া নাড়লুম। তা ভজনবাবু দরজা খুলে চারদিক দেখে ‘কোথায় কে’ বলে দরজা প্রায় বন্ধই করে দিচ্ছিলেন। এরকম সব হচ্ছে বাবা। অপমান আর সইছে না।”
বাঁকা মহারাজ চিন্তিত মুখে তার দিকে চেয়ে থেকে বললেন, “লম্বা হতে চাস?”
“যে আজ্ঞে। নইলে গলায় দড়ি দেব।”
বাঁকা মহারাজ বাঁকা হেসে বললেন, “কোন দুঃখে লম্বা হতে যাবি রে? মানুষ যত বেঁটে হয়, তার তত বুদ্ধি। লম্বা হতে চাস তো এক তুড়িতেই তোকে লম্বা করে দিতে পারি। কিন্তু তাতে কী হবে জানিস তো! মাথার যত রসকষ টেনে নিয়ে তোর শরীরটা ঢ্যাঙা হবে। তখন ভ্যাবলা হয়ে যাবি, বোকা হয়ে যাবি, ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে চারদিকের কাণ্ডকারখানা কিছুই বুঝতে পারবি না। লোকে বলবে, ওই দ্যাখ, একটা হাবাগোবা ঢ্যাঙা লোক যাচ্ছে।”
কথাটা শুনে তাড়াতাড়ি উঠে বসে সুধীর বলে, “তা হলে কি আমি বেশ বুদ্ধিমান লোক বাবা?”
“তা নোস তো কী? বামন অবতারের কথা শুনিসনি? বামন ভগবান তো তোর চেয়েও বেঁটে ছিল। তা বলে ক্ষমতা কম ছিল কি? রাম বেঁটে, কৃষ্ণ বেঁটে, হিটলার বেঁটে, নেপোলিয়ন বেঁটে। ওরে দুনিয়াটা তো বেঁটেদেরই হাতে।”
সুধীর তবু দোনামোনা করে বলে, “কিন্তু লোকে যে আমাকে মোটে লক্ষই করে না বাবা! বড় অপমান লাগে যে!”
“দুর পাগল, লোকের নজরে থাকা কি ভাল! সব সময় মানুষের নজরদারিতে থাকলে যে কাজকর্মে খুবই অসুবিধে। বরং বেঁটে বলে গা-ঢাকা দিয়ে কাজ গুছিয়ে নিতে পারবি। বেঁটে হওয়া তো ভগবানের আশীর্বাদ রে! কত লোক বেঁটে হওয়ার জন্য আমার কাছে এসে ধরনা দিয়ে পড়ে থাকে।”
সেই দিনই সুধীরের চোখের সামনে থেকে যেন একটা পরদা সরে গেল। তাই তো! বেঁটে হওয়ার সুবিধের দিকগুলো তো তার এতদিন নজরে পড়েনি! এই যে গোপাল সাধুখাঁর বাড়ির ঘুলঘুলি দিয়ে ঢুকে সে ক্যাশবাক্স সরিয়ে আনল, লম্বাচওড়া হলে পারত কি? কালীতলার সুখলাল শেঠের গদিতে ধরা পড়তে পড়তেও যে বেঁচে গেল, সে শুধু বেঁটে বলেই না! সুখলালের ছেলেটা তো ধরেই ফেলেছিল প্রায়, চড়চাপড়ও কষিয়েছিল কয়েকটা। কিন্তু সবই হাওয়া কেটে বেরিয়ে গেল। শেঠবাড়ির বড় নর্দমার ফুটো দিয়ে চম্পট দিতে তার তো কোনও অসুবিধেই হয়নি!”
সে তাড়াতাড়ি বাঁকা বাবাকে পেন্নাম করে বলল, “বাবা, আপনার আশীর্বাদে আমি যেন চিরকাল বেঁটেই থাকি।”
তা বাঁকা মহারাজের আশীর্বাদে সুধীর এখনও বেঁটেই আছে। আর বেঁটে থাকার আনন্দে তার মনটা মাঝে-মাঝে বড়ই উচাটন হয়। সাবধানের মার নেই বলে সে মাঝে-মাঝেই গিয়ে গোবিন্দপুরের হারু দর্জিকে দিয়ে নিজের মাপ নিয়ে আসে। গত হপ্তাতেই হারু তার মাপ নিয়ে বলল, “না রে, তুই সেই চার ফুট তিন ইঞ্চিই আছিস।”
মাঝেমধ্যে অবশ্য একটু দুশ্চিন্তা হয়। চার ফুট তিন ইঞ্চিটা কি একটু বেশিই লম্বা হয়ে গেল না! এতটা লম্বা হওয়া কি ভাল? বাসন্তী সার্কাসের জোকার হরগোবিন্দ মাত্র আড়াই ফুট। আর চরণগঙ্গার জটেশ্বর চার ফুটের চেয়েও কম। ষষ্ঠীতলার নগেন পাল চার ফুট এক ইঞ্চি। তা হলে কি সে লম্বাদের দলেই পড়ে গেল? আর একটু বেঁটে হলে কি ভাল হত না! আবার এও ভেবে দ্যাখে যে, বাঁকা মহারাজ যখন তাকে বেঁটে বলেছে, তখন সে নির্ঘাত বেঁটেই। তাই সুধীর মাঝে মাঝে গুনগুন করে গায়,
“বড় যদি হতে চাও, বেঁটে হও তবে।
দুনিয়াটা একদিন বেঁটেদেরই হবে।
বেঁটে যার পিতামাতা, বেঁটে যার ভাই,
তার মতো ভাগ্যবান আর কেহ নাই।
বেঁটেগণ যতজন আছে এই ভবে।
একত্রিত হলে তারা দুধেভাতে রবে।
বেঁটে পায়ে হেঁটে হেঁটে যাবে বহু দূর।
দুনিয়া লুটিয়া তারা আনিবে প্রচুর।
জয় বেঁটে, জয় বেঁটে, বেঁটেদের জয়।
বেঁটে হয়ে বেঁচে থাকো সদানন্দময়।”