কুঁজো পিসি ফোঁস করে একটা শ্বাস ছেড়ে বলে, “তবু বাপু, সাবধানের মার নেই। ছোঁড়াটা বড্ড চালাক-চতুর। চোখ দুটো যেন চারদিকে চরকির মতো ঘুরছে। মতলব মোটেই ভাল বুঝছি না।”
খোঁড়া পিসি ঝংকার দিয়ে বলে, “কার মতলবই বা ভাল দেখছিস লা? দুনিয়াতে কি আর ভাল লোক আছে? নাদু মালাকার তো এখনও মেটে হাঁড়ি নিয়ে এ বাড়ির আড়ায়-আড়ায় আমাদের ধরবার জন্য ঘুরে বেড়াচ্ছে। কালও দেখেছি, পিছনের ভাঙা দেওয়ালের ফাঁক দিয়ে আসশ্যাওড়ার আড়াল থেকে নজর দিচ্ছে। হ্যাঁ রে হরি, সত্যি করে বল তো, আমাদের ধরার জন্য নাদু তোকে কত টাকা দিতে চেয়েছে?”
হরিশ্চন্দ্র আমতা আমতা করে বলেন, “বেশি নয় পিসিমাগণ, নাদু মাত্র তিন হাজার টাকা কবুল করেছিল।”
কানা পিসি তার এক চোখ কপালে তুলে বলে, “মাত্র তিন হাজার! কী ঘেন্নার কথা! বাব্বাঃ, আমাদের দাম নাকি তিন হাজার! গলায় দড়ি।”
কুঁজো পিসি ফুঁসে উঠে বলে, “ড্যাকরার মুখোনা ভেঙে দিতে পারলি না রে হরি! আমরা হলুম গে চৈতন্যপুরের মহারাজাধিরাজের পিসি! সোজা পাত্তর তো নই রে বাপু!”
হরিশ্চন্দ্র কাতর কণ্ঠে বলেন, “রাগ করবেন না পিসিমাগণ। নাদুর ধারণা আপনারা ডাইনি৷ আর ডাইনির আত্মা দিয়ে নাকি অনেক কাজ হয়।”
কানা পিসি বলে, “আঁ! তার এত আম্পদ্দা!”
কুঁজো পিসি বলে, “ছোট মুখে এত বড় কথা!”
খোঁড়া পিসি বলে, “ওরে পিঁপড়ের পাখা গজিয়েছে।”
হরিশ্চন্দ্র কাঁচুমাচু হয়ে বললেন, “না না, সে কথা আমি তাকে ভাল করে বুঝিয়ে দিয়েছি। বলেছি, ওঁরা মোটেই ডাইনি ছিলেন না। ছয় পুরুষ আগেকার লতায়-পাতায় সম্পর্ক বটে, কিন্তু হিসেব করে দেখা গিয়েছে যে, আমরা পিসি আর ভাইপোই বটে। সে একটু গাঁইগুই করছিল বটে, বলছিল, মরার পর আর কীসের পিসি, কীসের ভাইপো! তা আমি তাকে বলে দিয়েছি, আমার পূজনীয়া পিসিমাদের দিকে যেন সে আর নজর না দেয়।”
কানা পিসি বলে, “ওরে, আমাদের হিসেব একেবারে পাকা। শুধু ভাইপোই নোস, আমাদের একমাত্র ওয়ারিশান।”
কুঁজো পিসি বলে, “আহা, শুধু ওয়ারিশান কেন, ও তো আমাদের নয়নের মণি!”
খোঁড়া পিসি বলে, “তা তো বটেই, এখনও যেন সেই ফুটফুটে খোকাটি।”
তিন পিসি ফুস করে বাতাসে উধাও হয়ে গেলে হরিশ্চন্দ্র একটু জল খেলেন। তিনি জানেন যে, তিনি ভুল দেখেন, ভুল শোনেন, ভুল বোঝেন এবং ভুল বলেও ফেলেন। কিন্তু এই ভুলভুলাইয়ার মধ্যেই তাঁকে ঘুরপাক খেতে হবে। ব্যাপারটা তাঁর তেমন খারাপও লাগে না। তবে কোনটা ভুল আর কোনটা ঠিক, তা নিয়ে একটু গণ্ডগোল হয় বটে।
এই যেমন কিছুদিন আগে নাদু ওঝা এক সকালবেলায় এসে তাঁর সামনে একটা মেটে হাঁড়ি রেখে পেন্নাম করে বলল, “কর্তামশাই,
হাঁড়ির মধ্যে বটের আঠা আর বন্ধনমন্ত্র মাখিয়ে দেওয়া আছে। তিনটি হাজার টাকা দিচ্ছি, ওই তিন ডাইনিকে ভুলিয়েভালিয়ে হাঁড়ির মধ্যে ঢুকিয়ে দিন, আমি সরা চাপা দিয়ে নিয়ে যাব।”
হরিশ্চন্দ্র একটু কৌতূহলী হয়ে জিজ্ঞেস করলেন, “তারপর কী হবে?”
নাদু বলল, “তারপর অনেক প্রক্রিয়া আছে। তিনজনকে ওই হাঁড়ির মধ্যে মজিয়ে শোধন করে যখন বের করব, তখন একেবারে মাটির মানুষ। যাই বলব, তাই লক্ষ্মী ছেলের মতো করবে।”
হরিশ্চন্দ্রের একবার ইচ্ছে হয়েছিল, তিন খিটকেলে বুড়িকে বেচেই দেন। এই বাজারে তিন হাজার টাকা কিছু কম নয়। দোকানে ধার বাকি আছে, কাজের লোকের বেতন বকেয়া পড়ে আছে, গয়লা তাগাদা দিচ্ছে। তারপর ভেবে দেখলেন, পিসিমাগণ তাকে দীর্ঘদিন ধরে গয়নাগাটি, হিরে-জহরত আর মোহরের লোভ দেখাচ্ছে বটে, কিন্তু উপুড়হস্ত করছে না। তবু একটা ক্ষীণ আশাও তো আছে। নাদু মালাকারের খপ্পরে গিয়ে পড়লে আশাটুকুও থাকবে না। গয়নাগাটিও ওই গাপ করবে।
হরিশ্চন্দ্র মাথা নেড়ে বললেন, “না হে বাপু, পিসি বিক্রি করা আমার কর্ম নয়। ওতে মহাপাপ।”
নাদু হাঁ হাঁ করে উঠে বলে, “আহা, সে তো জ্যান্ত পিসি কর্তামশাই। মরা পিসি, তাও লতায়-পাতায় সম্পর্ক, বেচতে দোষ কী?”
“মাত্র তিন হাজার টাকায় পিসিদের বিক্রি করে দেব, আমি কি সেরকম পাষণ্ড নাকি?”
নাদু দুঃখের সঙ্গে বলল, “দরটা কি কম মনে হল কর্তামশাই? বাজার ঘুরে দেখে আসুন গে, পিসির দর কত করে যাচ্ছে। পিসি প্রতি হাজার টাকায় আপনার মোটেই ঠকা হচ্ছে না।”
হরিশ্চন্দ্র দৃঢ়তার সঙ্গে বললেন, “না হে বাপু, পিসি বেচলে মহাপাতক। নরকবাস। পরকালের কথাটাও তো খেয়াল রাখতে হবে কিনা? তুমি বাপু, এসো গিয়ে।”
“দরটা না হয় আর একটু বাড়িয়ে দিচ্ছি কর্তা। তাতে আমার লোকসান যাবে অবশ্য, তা যায় যাবে।”
কিন্তু হরিশ্চন্দ্র রাজি হননি। নাদু মালাকার মনঃক্ষুণ্ণ হয়ে চলে গেল বটে, কিন্তু সে হাল ছাড়েনি। হরিশ্চন্দ্র মাঝেমধ্যেই খবর পান, নাদু একটা মেটে হাঁড়ি নিয়ে প্রাসাদের আদাড়ে-পাদাড়ে ঘুরঘুর করে বেড়ায়।
হরিশ্চন্দ্র সকালের পায়চারি সেরে সামনের চওড়া বারান্দায় একটা কেঠো চেয়ারে রোদে পা মেলে দিয়ে বসে আছেন। শরৎকাল। মোলায়েম হাওয়া দিচ্ছে। চারদিকে মৌমাছির গুনগুন শব্দ শোনা যাচ্ছে। বিচিত্র সব পাখির ডাক শোনা যাচ্ছে। আকাশে মেঘ আর রোদের খেলা। হরিশ্চন্দ্রের একটু ঢুলুনি মতো এসে গেল।
ঠিক এই সময়ে হিরু গণপতি একটা বন্দুক নিয়ে এসে হরিশ্চন্দ্রকে প্রণাম করে পায়ের কাছে বসল। হরিশ্চন্দ্র সভয়ে চেয়ে বললেন, “বন্দুক কীসের হে?”